আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি ১৯৭০-এর দশকে আমার বাবার সঙ্গে কলম্বো বন্দরে বিশেষ সফরে আসা তৎকালীন আইএনএস বিক্রান্তে—যা আগে এইচএমএস হারকিউলিস ছিল—উঠেছিলাম। তখন আমি ছোট, মডেল বিমান ও জাহাজ, বিশেষ করে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বানানোর শখে ডুবে থাকতাম। সেই অভিজ্ঞতা ভোলার মতো নয়। এটাই ছিল কোনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে আমার প্রথম ওঠা—ইস্পাতের এক দৈত্য, যা আমার কল্পনা ও বিস্ময় উভয়কেই ছুঁয়ে গিয়েছিল।
ঘূর্ণিঝড় দিতওয়া আঘাত হানার সময় আইএনএস বিক্রান্ত ও আইএনএস উদয়গিরি কলম্বো বন্দরে নোঙর করা ছিল। পরে ত্রাণ কার্যক্রম জোরদার করতে আইএনএস সুকন্যাও যোগ দেয়। তাই যখন ঘোষণা এল যে ভারত–নির্মিত নতুন আইএনএস বিক্রান্ত তার প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে শ্রীলঙ্কায় আসবে ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক নৌবহর পর্যালোচনা ও শ্রীলঙ্কা নৌবাহিনীর ৭৫ বছর উদ্যাপনের জন্য, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই আমাকে গভীরভাবে স্মৃতিকাতর করে তোলে। তবে পরে বুঝলাম, তার আগমন কতটা সৌভাগ্যজনক ও অর্থবহ হয়ে উঠেছে।
দিতওয়া ভয়াবহ শক্তি নিয়ে শ্রীলঙ্কায় আঘাত হানে। শতাধিক মানুষ নিহত হয়, লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় এবং দেশের অবকাঠামো ও ঘরবাড়ি ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত হয়। এরপরই সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য আবেদন জানায়। ভারত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাড়া দেয়। অপারেশন সাগরবন্ধুর আওতায় মানবিক সহায়তা দ্রুত মোতায়েন করা হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে আইএনএস বিক্রান্ত ও আইএনএস উদয়গিরি আগেই কলম্বোতে অবস্থান করছিল; পরে আইএনএস সুকন্যাও ত্রাণবহরে যুক্ত হয়।

গত কয়েক বছরে এটি ছিল তৃতীয় বড় দৃষ্টান্ত, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির নির্দেশনায় ভারত শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে ভ্যাকসিন মৈত্রী উদ্যোগের মাধ্যমে; দ্বিতীয়ত, ২০২২ সালের অর্থনৈতিক ধসের সময়ে যখন ভারত ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দেয়; এবং এখন ২০২৫ সালে দ্রুত দুর্যোগ-পরবর্তী সহায়তার মাধ্যমে।
এবার একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গ্রুপ—যা সাধারণত যুদ্ধ বা ভূ-রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের প্রতীক—পরিণত হলো মানবিক সহায়তার এক কার্যকর প্ল্যাটফর্মে। জরুরি ত্রাণ, চিকিৎসা সহায়তা, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং অনুসন্ধান–উদ্ধার কার্যক্রমে এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ভারতের এসব উদ্যোগ বহুমাত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল কূটনীতির এক নতুন আঞ্চলিক মডেল তুলে ধরে। ইন্দো–লঙ্কা সম্পর্ক এখন আর বিচ্ছিন্ন সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং মানবিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জ একই সঙ্গে মোকাবিলায় সক্ষম এক নমনীয় ও সমন্বিত কাঠামোয় পরিণত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তের একটিতে আইএনএস বিক্রান্তের উপস্থিতির প্রতীকী গুরুত্ব অত্যন্ত বড়। বিশ্ব রাজনীতিতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে সাধারণত শক্তি প্রদর্শনের উপকরণ হিসেবে দেখা হয়; কিন্তু কলম্বোতে বিক্রান্ত সামরিক সক্ষমতাকে মানবিক সহায়তা, শান্তি ও আস্থা বৃদ্ধির এক নতুন রূপে তুলে ধরেছে। এটি কঠোর শক্তির ভিতের ওপর দাঁড়ানো নরম শক্তির প্রকাশ—যা ভয় বা প্রদর্শন নয়, বরং সহমর্মিতা ও বাস্তববোধ দিয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে।

দিতওয়ার পর শ্রীলঙ্কা এখনও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০২২ সালের অর্থনৈতিক ধসের পর আইএমএফ-এর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চললেও, এত বড় দুর্যোগ সেই অগ্রগতিকে থামিয়ে দিতে পারে। ভারতের দ্রুত সাড়া শ্রীলঙ্কার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সক্ষমতাকে শক্তি জুগিয়েছে, তবে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন নিশ্চিত করতে আরও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সম্পদ আহরণ ও বিনিয়োগ প্রয়োজন।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত শ্রীলঙ্কার পুনর্নির্মাণে সমন্বিত একটি আঞ্চলিক উদ্যোগের নেতৃত্ব দিতে পারে—যা ভবিষ্যতের আঞ্চলিক সহযোগিতার মডেল হিসেবেও কাজ করতে পারে। এখানে জাপান স্বাভাবিক অংশীদার। শ্রীলঙ্কার দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে জাপান এবং ভারত—দুটি দেশই ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত সমন্বয়ে যুক্ত।
উল্লেখ্য, এই সপ্তাহেই নয়াদিল্লিতে চতুর্থ ভারত–জাপান ফোরাম বসছে, যেখানে দুই দেশের নীতিনির্ধারক, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেবেন। শ্রীলঙ্কার পুনর্গঠন ভারত–জাপান সহযোগিতার এক পরীক্ষামূলক প্রকল্প হয়ে উঠতে পারে, যা তাদের কৌশলগত সমন্বয় এবং উন্নয়ন সহযোগিতার শক্তিকে আরও দৃশ্যমান করবে।

পরপর সরকার এবং সাধারণ মানুষ—দু’পক্ষই ভারতের ধারাবাহিক সহযোগিতার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহের ঘটনাগুলো আবারও দেখিয়ে দিল, নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী মানে সেই বন্ধু, যে দেরি, দ্বিধা বা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নয়—বাস্তব সহায়তা নিয়ে প্রথমেই পাশে দাঁড়ায়।
যখন আইএনএস বিক্রান্ত—এক আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভর ভারতের প্রতীক—একটি যুদ্ধজাহাজ থেকে মানবিক সহায়তার জীবনরেখায় রূপান্তরিত হলো, তখন এটি আঞ্চলিক নেতৃত্বের নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির আগমনী বার্তাও ঘোষণা করল। যদি শ্রীলঙ্কা ভারত–জাপান যৌথ পুনর্গঠনের পরীক্ষাগার হয়ে ওঠে, তবে তা এশিয়ার কৌশলগত সহযোগিতায় আরও অর্থবহ এক অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে—যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, দায়িত্ববোধ হবে মূল চালিকা শক্তি।
লেখকঃ মিলিন্দা মোরাগোদা শ্রীলঙ্কার সাবেক মন্ত্রিসভার সদস্য ও কূটনীতিক, এবং পাথফাইন্ডার ফাউন্ডেশন নামক কৌশলগত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।
মিলিন্দা মোরাগোদা 


















