দ্রুত বদলে যাচ্ছে কাঠমান্ডুর সড়কচিত্র
জনঘনত্ব ও যানজটে বিপর্যস্ত কাঠমান্ডুর সরু রাস্তায় এখন প্রথাগত ডিজেল‑পেট্রল ইঞ্জিনের বিকট শব্দের বদলে শান্ত, মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। গত এক বছরে নেপালে বিক্রি হওয়া যাত্রীবাহী গাড়ির ৭৬ শতাংশই বৈদ্যুতিক; হালকা বাণিজ্যিক যানবাহনেও বাজারের অর্ধেক দখল তাদের। পাঁচ বছর আগেও এই হার ছিল শূন্যের কাছাকাছি। বিশ্বে গড় ই‑ভি বিক্রির হার ২০২৪ সালে যেখানে ২০ শতাংশ, নেপাল সেখানে এগিয়ে আছে নরওয়ে, সিঙ্গাপুর ও ইথিওপিয়ার পরেই।
নীতিগত উৎসাহ ও ‘জলবিদ্যুৎ’ সুবিধা
২০১৫ সালে ভারতের সীমান্ত অবরোধ নেপালের তেল‑নির্ভরতা স্পষ্ট করে দেয়। এরপর সরকার জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, গ্রিড ও চার্জিং অবকাঠামোয় ব্যাপক বিনিয়োগ করে। আজ প্রায় সব বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, লোডশেডিং প্রায় উঠে গেছে। এই ‘ঘরে তৈরি’ সবুজ শক্তিকে পরিবহনে ব্যবহার করতেই সরকার তিন দফা প্রণোদনা চালু করে—
কম শুল্ক: ২০২১ থেকে ই‑ভির আমদানি শুল্ক‑ভ্যাট সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ, যেখানে পেট্রল‑ডিজেল গাড়িতে ১৮০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে একটি বৈদ্যুতিক এসইউভি (হুন্ডাই) এখন গাড়িটির জ্বালানিচালিত সংস্করণের চেয়ে সস্তা।
চার্জার অবকাঠামো: নেপাল বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ (এনইএ) রাজধানী এবং মহাসড়কজুড়ে ৬২টি ফাস্ট চার্জার বসিয়েছে; ট্রান্সফর্মার বিনা খরচে সরবরাহ করেছে; চার্জার আমদানিতেও প্রায় শূন্য শুল্ক রেখেছে।
সস্তা বিদ্যুৎ: চার্জিং স্টেশনে ইউনিটপ্রতি দাম বাজারমূল্যের অনেক নিচে, যার ফলে তেলের সমতুল্য খরচের তুলনায় ব্যয় প্রায় ১৫ গুণ কম। এতে হোটেল‑রেস্তোরাঁ‑পথের ধারের উদ্যোক্তারা অনায়াসে চার্জার বসাচ্ছেন; সরকারি‑বেসরকারি স্থাপনা মিলিয়ে চার্জারের সংখ্যা এখন ১,২০০‑এর বেশি।
চীনা গাড়ির দাপট: বাজারমুখী ‘উইন‑উইন’
বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাটারি‑গাড়ি প্রস্তুতকারক চীনা ব্র্যান্ডগুলো বিপুল ছাড়ে নেপালের বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিওয়াইডি‑র সোলার সরঞ্জাম ব্যবসায়ী ইয়ামুনা শ্রেষ্ঠা ২০১৬ সালে শেনচেনে কারখানা ঘুরে এসে ই‑ভি আমদানির লাইসেন্স নেন, যখন অধিকাংশ ডিলারই সন্দিহান ছিল। আজ তাঁর ১৮টি শোরুম; ২০২৫‑এ ৪,০০০ গাড়ি বিক্রির লক্ষ্য। সাড়ে সাত ঘণ্টার কাঠমান্ডু‑জনকপুর রুটে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা জিত বাহাদুর সাহি ৩৩ হাজার ডলারে বৈদ্যুতিক মিনিবাস কিনে মাসে দশ‑বারো রাউন্ড ট্রিপেই কিস্তি মেটাচ্ছেন।
মূল্যছাড় কমলে অনিশ্চয়তা
তরুণ গণতন্ত্র নেপালে গত পাঁচ বছরে তিন প্রধানমন্ত্রী বদলেছেন; নীতির ধারাবাহিকতা নিয়ে ব্যবসায়ীদের শঙ্কা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ই‑ভির অগ্রিম জমা দ্বিগুণ করেছে, রাজস্ব ঘাটতি পুষতে শুল্ক বাড়ানোর কথাও উঠছে। এখনও ব্যাটারি পুনর্ব্যবহার বা নষ্ট ব্যাটারি ব্যবস্থাপনার নীতিমালা তৈরি হয়নি; ত্রুটিপূর্ণ সস্তা ব্র্যান্ডের গাড়ি বাজারের সুনাম নষ্ট করতে পারে—ডিলারদের দাবি, নিরাপত্তা‑সনদ দিতে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গড়া জরুরি।
গণপরিবহনে বড় ফাঁক: বাস‑স্কুটারই মূল দূষণ
নেপালের বেশির ভাগ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি নয়, বাস বা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে—এগুলোর প্রায় সবই তেলচালিত। উপ‑নগর ললিতপুরের মেয়র চিরি বাবু মহারজন স্বীকার করেন, গলিঘুঁজির শহরে ই‑স্কুটার এখনও জনপ্রিয় হয়নি। সমাধান হিসেবে রাজ্য‑অধিকাংশ মালিকানাধীন সাঝা ইয়াতায়াত ইতিমধ্যে ৪১টি বৈদ্যুতিক বাস চালাচ্ছে; সরকার প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ ডলার ভর্তুকি দিয়েছে। তবে পুরো উপত্যকায় বিকল্প গড়তে প্রয়োজন অন্তত ৮০০ বাস। চীন ১০০টি বড় ই‑বাস উপহার দিতে রাজি হয়েছে, যা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে।
টেকসই ভবিষ্যৎ: নীতি‑নিয়ন্ত্রণই চাবিকাঠি
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে বাঁধ, গ্রিড ও চার্জার তৈরি হলেও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—ভর্তুকি হঠাৎ বন্ধ হলে পরিবর্তনের গতি থেমে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল নীতি, ব্যাটারি রিসাইক্লিং ব্যবস্থা এবং একটি আঞ্চলিক পরিবহন কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে পারলেই দূষণমুক্ত, সাশ্রয়ী পরিবহন নেপালের বাস্তবতা হবে।
কাঠমান্ডুর উপত্যকা যেন চাবি ঘুরিয়ে অপেক্ষা করছে—গণপরিবহনও বৈদ্যুতিক হয়ে গেলে আর পাঁচ বছরেই ভিন্ন এক শহর দেখার আশা করছেন পরিকল্পনাবিদরা।