খননযজ্ঞের সূচনা
তামিলনাড়ুর মাদুরাই থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরের ছোট্ট গ্রাম কীলাড়ি। ২০১৩ সালে ১০০টি সম্ভাব্য স্থানের মধ্যে এটিকে বেছে নেন এএসআই‑এর প্রত্নতত্ত্ববিদ কে সফর আরামরামাকৃষ্ণন। ২০১৪ থেকে এখন পর্যন্ত দশ দফা খননে মাত্র চার একর জমি থেকে উদ্ধার হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি নিদর্শন—যার মধ্যে রয়েছে পোড়ামাটির কুণ্ড, মুদ্রা, নানাবর্ণের পুঁতি, দাহক্রিয়ার মৃতপাত্র ও টেরাকোটা পাইপ।
মাটির তলায় কী মিলল
চার-পাঁচ মিটার গভীর ট্রেঞ্চে উন্মোচিত ইটের ঘর, ছাদঢাকা জলবাহী ব্যবস্থা, পৃথক আবাস ও কারখানা এলাকায় গড়ে ওঠা একটি সুসংগঠিত নগরী—প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই ভূমিতে এক টি সুশিক্ষিত, শিল্পনির্ভর নগর সমাজের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলছে।
সময়কাল ও সভ্যতার গুরুত্ব
কার্বন‑তারিখ নির্দেশ করছে, সবচেয়ে পুরোনো স্তর প্রায় ই.পূ. ৫৮০ সালের। অর্থাৎ ইন্দাস‑উত্তর যুগে, গঙ্গা‑সমভূমির বৈদিক নগরায়নের সমসাময়িক দক্ষিণেও শহরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
লিপি বিতর্ক: তামিল ব্রাহ্মী বনাম অশোকীয় ব্রাহ্মী
খননকৃত পোড়ামাটির খন্ডে ছয় শতক ই.পূ.‑এর তামিল ব্রাহ্মী গ্রাফিতির খোঁজ গবেষকদের একাংশকে বিশ্বাস করাচ্ছে যে এই লিপি অশোকীয় ব্রাহ্মীর চেয়েও প্রাচীন; দু’টিই হয়তো ইন্দাস লিপি থেকে স্বাধীনভাবে বিকশিত। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে আরও প্রামাণ্য গবেষণার দাবি তুলেছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
কেন্দ্র–রাজ্য টানাপোড়েন
২০১৭ সালে প্রথম দুই দফা খননের পর হঠাৎই এএসআই‑এর বদলির নির্দেশে সরিয়ে দেওয়া হয় আরামরামাকৃষ্ণনকে। সম্প্রতি তাঁর ৯৮২‑পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদনকে “বৈজ্ঞানিক মানদণ্ডে দুর্বল” বলে সংশোধনের চাপ দেয় এএসআই। আরামরামাকৃষ্ণন তা প্রত্যাখ্যান করেছেন; তামিলনাড়ু সরকার অভিযোগ করছে, দিল্লি ইচ্ছাকৃতভাবে তামিল ইতিহাস ‘দমন’ করতে চাইছে।
রাজনীতিতে উত্তাপের কারণ
দক্ষিণ‑উত্তর বিভাজনের প্রেক্ষাপটে তামিল দলগুলো কীলাড়িকে ‘দ্রাবিড়ীয় গৌরব’-এর প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে, আর কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার খনন‑নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রচলিত ‘আর্য‑উত্তর’ ইতিহাস অটুট রাখার চেষ্টা করছে—এমন অভিযোগ বারবার উঠছে। ফলে প্রত্নতত্ত্বের মাটি গরম হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মঞ্চেও।
বিশেষজ্ঞদের ভিন্নমত
কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে, ইন্দাস উপত্যকার নাগরিকরা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে এতদূর দক্ষিণে গণহারে স্থানান্তরিত হওয়া অসম্ভব; সুতরাং কীলাড়ির নগরায়নকে ‘ক্ষুদ্র উপনিবেশ’ হিসেবেই দেখা উচিত। অপরদিকে রাজ্য‑গবেষকরা জোর দিচ্ছেন বড় পরিসরের একটি নগর ধারাবাহিকতার ওপর—যার পূর্ণ ছবি পেতে আরও খনন জরুরি।
জনগণের আগ্রহ ও জাদুঘর
পাশের নবনির্মিত কীলাড়ি জাদুঘরে প্রতিদিনই ভিড় করছেন স্কুলশিক্ষার্থী থেকে ইতিহাস‑উৎসাহী পর্যটকরা। মুক্ত আকাশের নিচে খনন‑ভূমিকে ‘ওপেন‑এয়ার মিউজিয়াম’ বানানোর কাজ চলছে, যেখানে ইটের প্রাচীন স্থাপনা ও টেরাকোটা রিং‑ওয়েল দেখেই অতীত ছুঁয়ে দেখা যাবে।
আলো‑আধারে কথা
কীলাড়ির মাটি কেবল মৃত ইতিহাস নয়; এটি উত্তর‑দক্ষিণ পরিচয়‑রাজনীতির সমকালীন প্রেক্ষাপটেও আলোড়ন তুলছে। প্রাচীন নগরায়ন, প্রাক‑অশোকীয় লিপি ও সমসাময়িক ইন্দাস‑তামিল যোগসূত্রের নতুন প্রশ্ন আমাদের আলো‑আধারে কথা বলে—ইতিহাসের মর্মোদ্ধার যেমন চলবে, তেমনি চলবে সংশয়ে‑সমালোচনায় গড়ে ওঠা একটি বৃহত্তর গণআলোচনাও।