পারমাণবিক শক্তি খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ
মুম্বাই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুতে ভারত সরকার পারমাণবিক খাতকে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করতে আইনি সংস্কারের প্রস্তাব দেয়। তবে এ প্রক্রিয়ায় রয়েছে জটিল আইন,ব্যুরোক্রেটিক বাধা এবং পরিবেশবাদীদের কঠোর বিরোধিতা—যা নতুন কেন্দ্র স্থাপনে বড় প্রতিবন্ধক হতে পারে।
ভারতের লক্ষ্য ২০৪৭ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৮ গিগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে ১০০ গিগাওয়াটে উন্নীত করা। এই উদ্যোগ ব্যাহত হতে পারে যদি দায়িত্ব সংক্রান্ত আইন ও অন্যান্য কাঠামোগত সমস্যা দ্রুত সমাধান না করা হয়।
বর্তমানে ভারতের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহে পারমাণবিক শক্তির অবদান মাত্র ৩ শতাংশ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে এটি ১৯ শতাংশ এবং ফ্রান্সে প্রায় ৬৪ শতাংশ। এই দুটি দেশই ভারতের পারমাণবিক বাজারে প্রবেশে আগ্রহী, বিশেষ করে ২০০৮ সালে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তির পর থেকে।
সম্প্রতি ভারতের সফরে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জানান, তাঁর প্রশাসন ভারতের পারমাণবিক শক্তি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহযোগিতা করতে চায়। দুই দেশের মধ্যে একটি বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চলছে, যার আওতায় প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত হবে।
আইন সংশোধনের উদ্যোগ ও বিদেশি মালিকানার প্রস্তাব
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সরকার পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশোধনের ঘোষণা দেয়। এছাড়া এপ্রিলের শেষের দিকে রয়টার্স জানায়, সরকার পারমাণবিক কেন্দ্রে বিদেশি শেয়ারহোল্ডিং সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদনের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই আইনি সংশোধনের পাশাপাশি প্রয়োজন হবে সহায়ক নীতিমালা ও কাঠামোগত সংস্কার—না হলে বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা কঠিন হবে। সেই সঙ্গে পারমাণবিক দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে জনমনে উদ্বেগও একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
দায়িত্ব আইন প্রধান বাধা: বিশ্লেষকদের মত
তক্ষশশীলা ইনস্টিটিউশনের গবেষক সৌরভ তোডি বলেন, প্রথম যে আইনটি পরিবর্তন করা হতে পারে তা হলো ‘সিভিল লায়াবিলিটি ফর নিউক্লিয়ার ড্যামেজ অ্যাক্ট’। এই আইন অনুযায়ী, পারমাণবিক কেন্দ্রে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো দুর্ঘটনার জন্য সীমাহীন দায়ে পড়তে পারে—যা সাধারণত কেবল কেন্দ্র পরিচালকের ওপর বর্তায়।
এই দায়বদ্ধতার কারণেই ফ্রান্সের ইডিএফ এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্টিংহাউস ইলেকট্রিকের ভারতীয় প্রকল্পগুলো—মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্র প্রদেশে—বহু বছর পরও অগ্রসর হতে পারেনি।
নতুন ইউনিট নির্মাণ ও ছোট রিঅ্যাক্টরের পরিকল্পনা
গুজরাটের কাকরাপার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নতুন দুটি ইউনিট (প্রত্যেকটির ক্ষমতা ৭০০ মেগাওয়াট) নির্মাণে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এনপিসিআইএল ব্যয় করেছে আনুমানিক ২২৫ বিলিয়ন রুপি (প্রায় ২.৬৩ বিলিয়ন ডলার)। ইউনিট দুটি ২০২৩ ও ২০২৪ সালের মধ্যে গ্রিডে যুক্ত হয়।
অর্থমন্ত্রী ফেব্রুয়ারিতে জানান, ২০৩৩ সালের মধ্যে দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত অন্তত পাঁচটি ছোট মডিউলার রিঅ্যাক্টর চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে নতুন চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন ও জ্বালানির (যেমন ইউরেনিয়াম) নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। যদিও কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (যেমন লার্সেন অ্যান্ড টুব্রো, ওয়ালচন্দনগর ইন্ডাস্ট্রিজ) প্রকৌশল ও নির্মাণ খাতে সহযোগিতা করে, মূল নিয়ন্ত্রণ এনপিসিআইএলের হাতে।
ক্রিসিলের জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক প্রণব মাস্টার বলেন, ভবিষ্যতে বেসরকারি অংশীদারদের জমি অধিগ্রহণ ও গ্রিড নির্মাণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন হবে। এছাড়া এই খাতে প্রচুর প্রাথমিক মূলধন বিনিয়োগ প্রয়োজন—যার জন্য সরকারের ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং বা ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশন থেকে সহায়তা লাগবে।
সংস্কার দরকার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যেও
বর্তমানে পারমাণবিক গবেষণা, প্রকল্প অনুমোদন, নির্মাণ ও নিরীক্ষণ একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে—যেমন ভাভা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার, এনপিসিআইএল এবং অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড (এএইআরবি) সবই একই বিভাগের অধীন।
সৌরভ তোডি বলেন, প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এএইআরবি-কে একটি স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থায় পরিণত করা জরুরি।
অতীতের দুর্ঘটনা ও জনমনে ভীতি
১৯৮৪ সালের ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা ও ২০১১ সালের জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের স্মৃতি এখনো জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ভোপাল দুর্ঘটনায় হাজার হাজার মানুষ নিহত ও লাখো মানুষ আহত হন, যা ঘটেছিল মার্কিন কোম্পানি ইউনিয়ন কার্বাইড পরিচালিত কীটনাশক কারখানায়।
২০১১ সালে তামিলনাড়ুর কুদানকুলাম পারমাণবিক কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী এস.পি. উদয়কুমার জানান, আগামী জুন থেকে ‘ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অফ অ্যান্টি-নিউক্লিয়ার মুভমেন্টস’ বিদেশি ও বেসরকারি কোম্পানির প্রবেশের বিরুদ্ধে লবিং শুরু করবে।
তিনি বলেন, “মোদি সরকার পারমাণবিক খাত বেসরকারিকরণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওরা জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে, কিন্তু এটা আসলে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষতি করছে। আমরা তো সেনাবাহিনীকে বেসরকারিকরণ করছি না।”
দ্রুত বাড়ছে বিদ্যুৎ চাহিদা, পারমাণবিক শক্তি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ
তবে ভারতের বিদ্যুৎ চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও ডেটা সেন্টারের মতো খাতে। সৌরভ তোডি মনে করেন, এই খাতগুলোর জন্য নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারমাণবিক শক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সার্বিকভাবে, সংস্কার এবং বিনিয়োগের জটিলতা সত্ত্বেও, ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ নিরাপত্তা ও কার্বন নির্গমন হ্রাসে পারমাণবিক শক্তি ভারতের জন্য একটি সম্ভাবনাময় পথ হিসেবে থেকে যাচ্ছে।