শুল্ক যুদ্ধের বিরতিতে সাময়িক স্বস্তি, তবে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে
সিঙ্গাপুরের নির্মাণ খাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈশ্বিক শুল্ক আরোপের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। স্থানীয় নির্মাণ কোম্পানিগুলো কাঁচামালের দাম ও সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির শিল্প সংগঠনগুলো।
যদিও সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ৯০ দিনের এক শুল্ক বিরতির ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের বিঘ্নের ঝুঁকি কিছুটা কমেছে, বিশ্লেষকরা এখনো সিঙ্গাপুরে নির্মাণ সামগ্রীর দামের ওপর শুল্কের প্রভাব নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন।
বিশ্বজুড়ে কাঁচামাল ঘাটতি, এশিয়াতেও প্রভাব
সিঙ্গাপুর ম্যানুফ্যাকচারিং ফেডারেশনের (SMF) নির্মাণ উপকরণ ও বিল্ডিং প্রোডাক্টস শিল্প গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান বেঞ্জামিন লিম বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের শুল্ক বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে সংকুচিত করছে। এর প্রভাব সিঙ্গাপুরেও পড়তে শুরু করেছে।”
তিনি জানান, চীন ও ভারতের কারখানাগুলো আগামী ছয় থেকে সাত মাসের জন্য সম্পূর্ণ বুকড। মার্কিন ক্রেতারা অগ্রিম মালপত্র মজুত করে ফেলায় এশিয়ায় সরবরাহ কমে গেছে এবং দাম বেড়েছে।
শুল্ক বিরতির সীমাবদ্ধতা ও অ্যালুমিনিয়ামের দামের অস্থিরতা
গত ১২ মে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পারস্পরিক কিছু শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে মার্চ ও এপ্রিল মাসে ঘোষিত ২৫ শতাংশ স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, গাড়ি ও এর যন্ত্রাংশের ওপর নির্ধারিত খাতভিত্তিক শুল্ক এখনো বহাল রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি গাড়ির জন্য রিবেট বা যুক্তরাজ্যের জন্য আংশিক ছাড় থাকলেও এই শুল্কগুলো পুরোপুরি প্রত্যাহার হয়নি।
‘লিবারেশন ডে’-তে ঘোষিত ১০ শতাংশ সার্বজনীন শুল্কও এখনো কার্যকর আছে।
অ্যালুমিনিয়ামের দামে বড় অস্থিরতা দেখা গেছে: সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ প্রতি টনের দাম ছিল ২,৪৪৯.৯০ ডলার, যা মার্চ ২০২৫-এ বেড়ে ২,৬৫৮.৩০ ডলারে পৌঁছায়। এরপর এপ্রিলে এটি কমে দাঁড়ায় ২,৩৭১.৬০ ডলারে।
লিম বলেন, “এই দামের ওঠানামার কারণে বাজেট পরিকল্পনা ও কেনাকাটায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কিছু নির্মাণ সামগ্রী প্রস্তুতকারীরা অ্যালুমিনিয়ামের বেশি দাম ও দীর্ঘ ডেলিভারি সময়ের মুখে পড়েছেন।”
তিনি আরও জানান, বড় প্রকল্পে নির্মাণ সামগ্রীর দামে ৫ থেকে ১০ শতাংশ বাড়তি খরচ মানে বাজেটে কয়েক মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত যোগ হতে পারে। বিশেষ করে অ্যালুমিনিয়ামনির্ভর সামগ্রী যেমন ফ্যাসাড ও ফিটিংসে এই সমস্যা বেশি।
স্টিলের বাজার এখনো স্থিতিশীল, তবে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি রয়ে গেছে
লিম জানান, এখন পর্যন্ত স্টিলের ওপর শুল্ক সিঙ্গাপুরে বড় ধাক্কা দেয়নি। তবে বিশ্বজুড়ে চাহিদা বাড়লে এবং সরবরাহ সংকুচিত হলে আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে প্রভাব পড়তে পারে।
নির্মাণ খাতে অস্থিরতার শঙ্কা: সময়ের ওপর নজর রাখার পরামর্শ
সিঙ্গাপুর কন্ট্রাক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের (Scal) সভাপতি লি কাই চাই বলেন, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর নির্দিষ্ট খাতভিত্তিক শুল্ক সিঙ্গাপুরে নির্মাণ খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে ৯০ দিনের বিরতি বৈশ্বিক দামের ক্ষেত্রে কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে পারে।
তিনি বলেন, “সিঙ্গাপুরে প্রকৃত খরচ কী হবে তা নির্ভর করবে দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি ও বাজার মনোভাবের পরিবর্তনের ওপর।”
লি আরও বলেন, নির্মাণ খাত এখনো শুল্ক উত্তেজনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে প্রকল্পের সময়সীমা ও উপকরণ সরবরাহের ওপর নজর রাখতে হবে।
চীনা রপ্তানির পুনর্নির্দেশ ও আঞ্চলিক প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক শুল্ক পরিবর্তনের কারণে চীনা রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য আঞ্চলিক বাজারে যেমন আসিয়ানে পুনঃনির্দেশ করছে। কারণ, একদিকে এই অঞ্চলে নির্মাণ চাহিদা বাড়ছে, অন্যদিকে তৃতীয় কোনো দেশে যেমন ইন্দোনেশিয়ায় চূড়ান্ত প্রক্রিয়াকরণ করলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে কম শুল্ক দিতে হতে পারে।
এশিয়া-প্যাসিফিকে কিছু সুফলও আসতে পারে
কুশম্যান অ্যান্ড ওয়েকফিল্ডের আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রধান ড. ডোমিনিক ব্রাউন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের সম্ভাবনা থাকায় সেসব অঞ্চলে নির্মাণ খরচ বাড়বে এবং নির্মাণ গতি কমবে। এতে করে বিশ্ববাজারে কিছু অতিরিক্ত পণ্য মজুত হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, “এশিয়া-প্যাসিফিকে এখনো তুলনামূলক কম শুল্ক আরোপ আছে এবং এখানে ২৩ কোটি বর্গফুটের বেশি অফিস স্পেস নির্মাণাধীন। অতিরিক্ত পণ্য এই অঞ্চলে আসলে স্বল্পমেয়াদে কাঁচামালের দামে কিছুটা পতন হতে পারে।”
তবে ড. ব্রাউন এটাও মনে করিয়ে দেন, কাঁচামালের দাম উন্নয়ন খরচের একটি অংশ মাত্র। শিপিং খরচ, স্থানীয় শ্রম ও জমির দামও প্রকল্পের লাভজনকতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সিঙ্গাপুরে নির্মাণ খাত একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন শুল্ক বিরতির কারণে সাময়িক স্বস্তি পেলেও ভবিষ্যতের কাঁচামাল সরবরাহ ও মূল্যের অনিশ্চয়তা এখনও রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা শুল্ক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখতে এবং প্রকল্প পরিকল্পনায় সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন।