আগুন ও সুরের কবি
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯–১৯৭৬)—বাংলাদেশের জাতীয় কবি, যিনি “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে খ্যাত—ছিলেন এক অন্তর্ভেদী, দুর্ধর্ষ, সাহসী চিন্তাশীল লেখক।তাঁর কাব্য, প্রবন্ধ, গান ও বক্তৃতা ছিল দাসত্ব, নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িকতা ও পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে একজোট যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে তাঁর কলম কখনো প্রেমের স্পর্শে কোমল, কখনো বজ্রকঠিন উচ্চারণে দৃঢ়। নজরুল একাধারে ছিলেন বিদ্রোহী, প্রেমিক, গায়ক ও মানবতাবাদী।
নারীর মুক্তির কণ্ঠস্বর—“নারী আজ বন্দিনী”
নজরুল নারীর স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তিনি নারীদের শুধুমাত্র সহধর্মিণী নয়, সমমর্যাদার স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করেছেন। তাঁর গদ্যে তিনি স্পষ্ট লিখেছেন—
“নারী আজ বন্দিনী। সংসারের কারাগারে, সমাজের জালে, ধর্মের শিকলে।
কিন্তু সে যে পাষাণ নয়—সে যে রক্তমাংসের মানুষ।
সে শুধু পুরুষের সেবিকা নয়, সে মানুষ, সে স্বাধীন সত্তা।
তাকে বল হে পুরুষ: আমি তোমার মতোই স্বাধীন।”
এই উক্তির মাধ্যমে নজরুল নারীদের তাদের স্বকীয়তা, আত্মসম্মান এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার দাবি করতে বলেন। তাঁর মতে, যে সমাজ নারীর সম্মান দিতে পারে না, সে কখনো সভ্য হতে পারে না। তিনি বলেন—
“যে ধর্মে নারীকে অপমান করা হয়, সে ধর্মকে আমি শত্রু মনে করি।”
এমন জোরালো বক্তব্য নজরুলের বিপ্লবী অবস্থানকেই প্রকাশ করে, যেখানে নারীকে সামাজিক ক্ষমতায়নের কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।
ধর্মীয় ব্যবসার বিরুদ্ধে নির্মম বিদ্রোহ
নজরুলের বিদ্রোহ শুধু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ছিল না; তিনি স্পষ্টভাবে সমালোচনা করেছেন সেই সব ধর্মব্যবসায়ীর, যারা ধর্মকে লোভ ও ক্ষমতার হাতিয়ার বানিয়ে নিরীহ মানুষকে বিপথে ঠেলে দেয়। তাঁর কবিতা “গোঁড়ামি ধর্ম নয়”-এ তিনি লেখেন—
“যাহারা গুন্ডা, ভণ্ড, তারাই ধর্মের আবরণে
স্বার্থের লোভে খ্যাপাইয়া তোলে অজ্ঞান জনগণে।”
তিনি আরও লেখেন—
“ধর্মকে আজ ব্যবসা বনাইয়া তুলিল যে,
তার চেয়ে বড় পাপী আর কে আছে এ জগতে?”
এখানে নজরুল ধর্মের প্রকৃত চেতনাকে তুলে ধরেন: প্রেম, মানবতা, করুণা ও ন্যায়বোধ। তিনি বিশ্বাস করতেন, যাঁরা ধর্মের নামে বিভাজন ঘটান, তাঁরা ধর্মের নয়, ক্ষমতার প্রতিনিধি।
ধর্মীয় মিলনের প্রতীক “সাম্যবাদী” নজরুল
নজরুল চেয়েছেন এমন এক সমাজ, যেখানে ধর্ম, জাত, বর্ণের বিভেদ থাকবে না। তাঁর “সাম্যবাদী” কবিতায় তিনি লেখেন—
“গাহি সাম্যের গান—
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।”
তিনি শুধু কবিতায় নয়, বাস্তব জীবনে ছিলেন ধর্মীয় মিলনের প্রতীক। তাঁর লেখায় যেমন ইসলামী হামদ ও গজল ছিল, তেমনি ছিল শ্যামাসঙ্গীত ও বৈষ্ণব পদ। তিনি নিজেই বলেছেন—
“আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বিশ্বাস করি,
আমি চাই, একদিন পৃথিবীতে এমন একটা সমাজ হবে, যেখানে পরিচয় হবে শুধু একটাই—আমি মানুষ।”
এই কথাগুলো আজও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি।
গান যেখানে ধর্মের দেয়াল ভাঙে
নজরুল রচনা করেছেন ৩,০০০-এরও বেশি গান—নজরুলগীতি—যার মধ্যে সব ধর্ম, ভাষা ও সম্প্রদায়ের মানুষ খুঁজে পেয়েছেন নিজের প্রতিচ্ছবি। তাঁর গান “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান” আজও জাতিকে সম্প্রীতির বাণী শোনায়।
তিনি গেয়েছেন—
“মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।
ভেদাভেদ ভুলে মোরা গাই একতার গান।”
এই গান ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভাজনকে সুরে মিলিয়ে দিয়েছে।
এখনো জাগ্রত এক বিদ্রোহী চেতনা
নজরুলের কাব্য ও গদ্য আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক সমাজের, যেখানে নারী নিজের অধিকারে দাঁড়াবে, ধর্ম হবে শান্তির হাতিয়ার, আর জাত-ধর্ম-বর্ণের ভেদ হবে অতীত।
আজও যখন একজন শিক্ষিত নারী পেশাগত জীবনে লড়াই করে এগিয়ে যান, কোনো তরুণ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, বা কেউ ধর্মের নামে বিভাজনের প্রতিবাদ জানায়—তখনই নজরুলের সেই চিরকালের আহ্বান শুনতে পাই:
“আমার নাম ‘বিদ্রোহী’, আমি বিদ্রোহ করতে এসেছি—
যত শৃঙ্খল, যত অন্ধতা, যত নিপীড়ন, সব ভাঙার জন্য।”