১১:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

রাজস্ব ঘাটতি, ঋণচাপ আর বেকারত্বের বাজেট যুদ্ধ

সংকটে ঘেরা অর্থনীতিবড় দায়িত্বের সামনে বাজেট প্রস্তুতি

আন্তর্জাতিক ঋণ ও বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত, প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৩ শতাংশে আটকে, রাজস্ব ঘাটতি গভীর—এই ত্রিমুখী সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। এমন সংকটকালে একটি কার্যকর ও জনমুখী বাজেট প্রণয়ন কেবল কঠিন নয়, অনেকাংশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পরীক্ষাও বটে।

বৈদেশিক সহায়তা নেইঋণনির্ভরতা বাড়ছে

আর্থিক বছর ২০২৫-২৬-এর জন্য বাজেট ঘোষণার আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে, সরকার এখনও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায়নি। আন্তর্জাতিক দাতাদের পক্ষ থেকেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রতিশ্রুতি আসছে না। ফলে নতুন বাজেট বাস্তবায়নে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে।

অর্থ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই সরকারি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে সুদ পরিশোধেই আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব খাতে তীব্র ঘাটতি

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে এনবিআরের জন্য ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, যা বাস্তবায়নে আদায় কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার এবং অটোমেশন ছাড়া সম্ভব নয়।

রাজস্ব আদায়ে কর অব্যাহতি ও শুল্কছাড় কমিয়ে নতুন খাত থেকে ভ্যাট ও কর সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বড় প্রশ্ন।

প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে: কর্মসংস্থানে ধস

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ৩.৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত এক দশকে সর্বনিম্ন। শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে এ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে।

একই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। এক বছরে বেকার বেড়েছে সোয়া ৩ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি এলসি ৩০ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথমেই স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাজেটকে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে—

  • মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি
  • গ্রামীণ অবকাঠামো ও কর্মসূচি বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরি
  • কর ব্যবস্থায় সংস্কার ও অটোমেশন
  • অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধে কঠোর নজরদারি

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, শুধু খরচ ও ঋণনির্ভরতা দিয়ে নয়, রাজস্ব খাতে সত্যিকারের সংস্কার ছাড়া সামগ্রিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।

বাজেট নয়নেতৃত্বেরও পরীক্ষা

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, “এটি শুধু বাজেটের সময় নয়, এটি রাষ্ট্র পরিচালনার সতর্ক সময়। এখন শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং কার্যকর বাস্তবায়ন ও জবাবদিহির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে সরকার মানুষের পাশে আছে।”

তিনি আরও বলেন, “নেতৃত্বের দুর্বলতা ও প্রশাসনিক জড়তা যদি কাটিয়ে না উঠতে পারি, তবে এ বাজেট জনমুখী নয়—অকার্যকর নথিতেই থেকে যাবে।”

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে যেকোনো বাজেট একটি ভারসাম্য রক্ষার খেলা। এই বাজেট হতে হবে চরম বাস্তববাদী, সংকট-সচেতন এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফেরানোর রূপরেখা। নাহলে সংকট আরও গভীর হবে, যা শুধু অর্থনীতি নয়—রাজনীতির জন্যও বড় ঝুঁকি বয়ে আনবে।

রাজস্ব ঘাটতি, ঋণচাপ আর বেকারত্বের বাজেট যুদ্ধ

০৪:৫২:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

সংকটে ঘেরা অর্থনীতিবড় দায়িত্বের সামনে বাজেট প্রস্তুতি

আন্তর্জাতিক ঋণ ও বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত, প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৩ শতাংশে আটকে, রাজস্ব ঘাটতি গভীর—এই ত্রিমুখী সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তুতের কাজ শুরু করেছে। এমন সংকটকালে একটি কার্যকর ও জনমুখী বাজেট প্রণয়ন কেবল কঠিন নয়, অনেকাংশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পরীক্ষাও বটে।

বৈদেশিক সহায়তা নেইঋণনির্ভরতা বাড়ছে

আর্থিক বছর ২০২৫-২৬-এর জন্য বাজেট ঘোষণার আগেই নিশ্চিত হয়ে গেছে, সরকার এখনও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পায়নি। আন্তর্জাতিক দাতাদের পক্ষ থেকেও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে প্রতিশ্রুতি আসছে না। ফলে নতুন বাজেট বাস্তবায়নে সরকারকে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে হবে।

অর্থ বিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যেই সরকারি ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে সুদ পরিশোধেই আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

রাজস্ব খাতে তীব্র ঘাটতি

চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আদায় করেছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে এনবিআরের জন্য ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, যা বাস্তবায়নে আদায় কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার এবং অটোমেশন ছাড়া সম্ভব নয়।

রাজস্ব আদায়ে কর অব্যাহতি ও শুল্কছাড় কমিয়ে নতুন খাত থেকে ভ্যাট ও কর সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বড় প্রশ্ন।

প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে: কর্মসংস্থানে ধস

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বর্তমানে ৩.৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত এক দশকে সর্বনিম্ন। শিল্প উৎপাদন, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে এ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে।

একই সঙ্গে বেড়েছে বেকারত্ব। এক বছরে বেকার বেড়েছে সোয়া ৩ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি এলসি ৩০ শতাংশ এবং নিষ্পত্তি কমেছে ২৫ শতাংশ, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথমেই স্বল্পমেয়াদি স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাজেটকে কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে—

  • মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি
  • গ্রামীণ অবকাঠামো ও কর্মসূচি বাড়িয়ে কর্মসংস্থান তৈরি
  • কর ব্যবস্থায় সংস্কার ও অটোমেশন
  • অপচয় ও দুর্নীতি বন্ধে কঠোর নজরদারি

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, শুধু খরচ ও ঋণনির্ভরতা দিয়ে নয়, রাজস্ব খাতে সত্যিকারের সংস্কার ছাড়া সামগ্রিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়।

বাজেট নয়নেতৃত্বেরও পরীক্ষা

অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, “এটি শুধু বাজেটের সময় নয়, এটি রাষ্ট্র পরিচালনার সতর্ক সময়। এখন শুধু সংখ্যা দিয়ে নয়, বরং কার্যকর বাস্তবায়ন ও জবাবদিহির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে সরকার মানুষের পাশে আছে।”

তিনি আরও বলেন, “নেতৃত্বের দুর্বলতা ও প্রশাসনিক জড়তা যদি কাটিয়ে না উঠতে পারি, তবে এ বাজেট জনমুখী নয়—অকার্যকর নথিতেই থেকে যাবে।”

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে যেকোনো বাজেট একটি ভারসাম্য রক্ষার খেলা। এই বাজেট হতে হবে চরম বাস্তববাদী, সংকট-সচেতন এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফেরানোর রূপরেখা। নাহলে সংকট আরও গভীর হবে, যা শুধু অর্থনীতি নয়—রাজনীতির জন্যও বড় ঝুঁকি বয়ে আনবে।