১০:১৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ঋণের ভারে নড়বড়ে বাজেট

বাংলাদেশে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘিরে সরকারের প্রধান মাথাব্যথা এখন অর্থের জোগান। মাত্র ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি-আশাভিত্তিক এই বাজেটকে টিকিয়ে রাখতে সরকার চুকিয়ে ফেলতে চাইছে নতুন ঋণ; অথচ বিদেশি সহায়তার তহবিল এখনও তালাবদ্ধ। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, ঋণনির্ভরতা বাড়াতে গিয়ে বেসরকারি খাতের শ্বাসরোধ এবং দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকা বৈদেশিক তহবিল—দুটি মিলেই শিল্প ও শ্রমবাজারকে রক্তশূন্য করে তুলেছে।

শীর্ষ ঋণ-উচ্চভবনের জানালায় ঝুলে আছে IMF-এর চেক

নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচির চতুর্থ-পঞ্চম কিস্তি মিলিয়ে ১.৩ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার শর্তে ‘মার্কেট-বেইজড’ ডলার বিনিময় হার মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী জুনে অর্থ ছাড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও টাকা এখনও আসেনি, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীভাবে ‘পরিচালিত ফ্লোট’ চালু করবে, সে-সংক্রান্ত সার্কুলার নিয়ে দোদুল্যমানতা কাটেনি। এর আগে জানুয়ারিতে চতুর্থ কিস্তি মার্চ পর্যন্ত স্থগিত হওয়ার পর বাজারে আস্থাহীনতা আরও চেপে বসে।

বিশ্বব্যাংক-এডিবির পূর্বাভাসে বিনিয়োগ হিমশীতল

বিশ্বব্যাংকের এপ্রিল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ রিয়েল জিডিপি বৃদ্ধিকে ২০২৫ অর্থবছরে ৩.৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে; কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগের ধারাবাহিক পতন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। একই মাসের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে ২০২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৩.৯ শতাংশে। দ্বিমুখী পূর্বাভাস-ঝুঁকি স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে শিল্প-উৎপাদন খাত ত্বরিত মন্দার গর্তে চলে যাচ্ছে।

শিল্পে হামলামামলাবন্ধতা

৫ আগস্টের রাজনৈতিক সহিংসতার পর থেকে সরকারি হিসাবে ৭৭৩ শিল্প-প্রতিষ্ঠানে হামলা, ১৫ হাজারের বেশি হত্যা মামলা এবং মোট ৩৫ হাজার ৭৭৩ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের কারণে উৎপাদন-চক্র থেমে গেছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৫০০ ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে; এর ৪ হাজারই ব্যবসায়ী-নির্ভর। ফলে গত দশ মাসেই সাড়ে ৩ হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার।

ধসে পড়ছে রপ্তানি ও পিএমআই

যেখানে তৈরি পোশাক খাত যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের ধাক্কা সামাল দিতেই হিমশিম, ভারতীয় স্থলসীমান্তে নতুন নিয়ন্ত্রণে বন্ধ হয়েছে ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলের পণ্য যাতায়াত। এদিকে এপ্রিলের পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (PMI)-এ ‘৫০’-এর নিচে নেমে গিয়েছে শিল্প-আশার রেখা, যা অর্থনীতির শ্লথগতির আগাম ইঙ্গিত।

ঋণ-তালিকায় নতুন জন্মে শিশুরও’ মাথায় এক লাখ টাকা

বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ১০৩ বিলিয়ন ডলার—জিডিপির ৪৫ শতাংশ। জনশুমারি অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের গড় মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় প্রায় ৭০০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক লাখ)। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ৪০ শতাংশের ঋণ-সীমা অতিক্রম করাকেই ‘রেড জোন’ ধরা হয়।

বেসরকারি খাতের ভরসা ছাড়া মুক্তি নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক জানালেন, “ঋণ জোগাড় করতে গিয়ে সরকার নীতিগত স্বাধীনতা হারাচ্ছে; অথচ উৎপাদনক্ষম বেসরকারি খাতকে অক্সিজেন দিলেই—করমুক্ত আমদানি কাঁচামাল, স্থিতিশীল ডলারদর, স্বল্পসুদে ঋণ—অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।” তার পরামর্শ:
• সব হয়রানি মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার
• জব্দ করা ব্যাংক হিসাব মুক্ত করা
• নীতি-নির্ধারণে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা
• রাজস্ব বাড়াতে করজাল প্রসার, হঠকারী ‘নতুন কর’ এড়ানো

ঋণের বিপন্ন নৌকা টেনে শিল্প-কল-চাকার গতি কমে গেলে শুধু বাজেট নয়—সমগ্র অর্থনীতি ভয়ঙ্কর অসারতায় পড়ে। বেসরকারি খাতকে আস্তিনে শত্রু ভেবে নয়, উন্নয়নের পার্টনার ভেবেই সামনে এগোতে হবে; নইলে বাজেট-ঘাটতি যেমন-তেমন পেটাচ্ছে, কর্মসংস্থানের মরুভূমিও সমান্তরাল বিস্তৃত হবে। এই সংকট থেকে বেরোতে হলে পদক্ষেপ এখনই—অন্যথায় ঋণ-চক্র আর শিল্প-অবসাদ মিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বপ্নকে অকালেই গিলে খাবে।

ঋণের ভারে নড়বড়ে বাজেট

০৪:০০:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

বাংলাদেশে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘিরে সরকারের প্রধান মাথাব্যথা এখন অর্থের জোগান। মাত্র ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি-আশাভিত্তিক এই বাজেটকে টিকিয়ে রাখতে সরকার চুকিয়ে ফেলতে চাইছে নতুন ঋণ; অথচ বিদেশি সহায়তার তহবিল এখনও তালাবদ্ধ। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, ঋণনির্ভরতা বাড়াতে গিয়ে বেসরকারি খাতের শ্বাসরোধ এবং দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকা বৈদেশিক তহবিল—দুটি মিলেই শিল্প ও শ্রমবাজারকে রক্তশূন্য করে তুলেছে।

শীর্ষ ঋণ-উচ্চভবনের জানালায় ঝুলে আছে IMF-এর চেক

নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার গত সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচির চতুর্থ-পঞ্চম কিস্তি মিলিয়ে ১.৩ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার শর্তে ‘মার্কেট-বেইজড’ ডলার বিনিময় হার মেনে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী জুনে অর্থ ছাড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও টাকা এখনও আসেনি, কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীভাবে ‘পরিচালিত ফ্লোট’ চালু করবে, সে-সংক্রান্ত সার্কুলার নিয়ে দোদুল্যমানতা কাটেনি। এর আগে জানুয়ারিতে চতুর্থ কিস্তি মার্চ পর্যন্ত স্থগিত হওয়ার পর বাজারে আস্থাহীনতা আরও চেপে বসে।

বিশ্বব্যাংক-এডিবির পূর্বাভাসে বিনিয়োগ হিমশীতল

বিশ্বব্যাংকের এপ্রিল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ রিয়েল জিডিপি বৃদ্ধিকে ২০২৫ অর্থবছরে ৩.৩ শতাংশে নামিয়ে এনেছে; কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে বেসরকারি ও সরকারি বিনিয়োগের ধারাবাহিক পতন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। একই মাসের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে ২০২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৩.৯ শতাংশে। দ্বিমুখী পূর্বাভাস-ঝুঁকি স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে শিল্প-উৎপাদন খাত ত্বরিত মন্দার গর্তে চলে যাচ্ছে।

শিল্পে হামলামামলাবন্ধতা

৫ আগস্টের রাজনৈতিক সহিংসতার পর থেকে সরকারি হিসাবে ৭৭৩ শিল্প-প্রতিষ্ঠানে হামলা, ১৫ হাজারের বেশি হত্যা মামলা এবং মোট ৩৫ হাজার ৭৭৩ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের কারণে উৎপাদন-চক্র থেমে গেছে। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ইতোমধ্যে ৬ হাজার ৫০০ ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে; এর ৪ হাজারই ব্যবসায়ী-নির্ভর। ফলে গত দশ মাসেই সাড়ে ৩ হাজার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে কয়েক লাখ শ্রমিক বেকার।

ধসে পড়ছে রপ্তানি ও পিএমআই

যেখানে তৈরি পোশাক খাত যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্কের ধাক্কা সামাল দিতেই হিমশিম, ভারতীয় স্থলসীমান্তে নতুন নিয়ন্ত্রণে বন্ধ হয়েছে ‘সেভেন সিস্টার্স’ অঞ্চলের পণ্য যাতায়াত। এদিকে এপ্রিলের পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (PMI)-এ ‘৫০’-এর নিচে নেমে গিয়েছে শিল্প-আশার রেখা, যা অর্থনীতির শ্লথগতির আগাম ইঙ্গিত।

ঋণ-তালিকায় নতুন জন্মে শিশুরও’ মাথায় এক লাখ টাকা

বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ১০৩ বিলিয়ন ডলার—জিডিপির ৪৫ শতাংশ। জনশুমারি অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের গড় মাথাপিছু ঋণ দাঁড়ায় প্রায় ৭০০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় এক লাখ)। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ৪০ শতাংশের ঋণ-সীমা অতিক্রম করাকেই ‘রেড জোন’ ধরা হয়।

বেসরকারি খাতের ভরসা ছাড়া মুক্তি নেই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক জানালেন, “ঋণ জোগাড় করতে গিয়ে সরকার নীতিগত স্বাধীনতা হারাচ্ছে; অথচ উৎপাদনক্ষম বেসরকারি খাতকে অক্সিজেন দিলেই—করমুক্ত আমদানি কাঁচামাল, স্থিতিশীল ডলারদর, স্বল্পসুদে ঋণ—অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।” তার পরামর্শ:
• সব হয়রানি মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার
• জব্দ করা ব্যাংক হিসাব মুক্ত করা
• নীতি-নির্ধারণে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা
• রাজস্ব বাড়াতে করজাল প্রসার, হঠকারী ‘নতুন কর’ এড়ানো

ঋণের বিপন্ন নৌকা টেনে শিল্প-কল-চাকার গতি কমে গেলে শুধু বাজেট নয়—সমগ্র অর্থনীতি ভয়ঙ্কর অসারতায় পড়ে। বেসরকারি খাতকে আস্তিনে শত্রু ভেবে নয়, উন্নয়নের পার্টনার ভেবেই সামনে এগোতে হবে; নইলে বাজেট-ঘাটতি যেমন-তেমন পেটাচ্ছে, কর্মসংস্থানের মরুভূমিও সমান্তরাল বিস্তৃত হবে। এই সংকট থেকে বেরোতে হলে পদক্ষেপ এখনই—অন্যথায় ঋণ-চক্র আর শিল্প-অবসাদ মিলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বপ্নকে অকালেই গিলে খাবে।