যেখানে সাধ, সেখানে সাধ্য নেই—বরিশালের রেলগাড়ি যেন সেই অপূর্ণ বাসনার গল্প!
এ দেশের মানুষের কাছে বরিশালের রেলগাড়ি অনেকটা অলীক কল্পনার মতো। কোনো কালেই সেখানে রেলপথ ছিল না, নেইও। বছর দুয়েক আগে সেখানে ট্রেনলাইন বসানোর জোর কথাবার্তা শুরু হয়েছিল বটে, তবে তা এখন ‘পা পিছলে আলুর দম’। আপাতত সেখানে ‘রেলগাড়ি ঝমাঝমের’ চিন্তা বাদ। এত নদী-খালের এলাকায় ট্রেন চলবে শুনে বরিশালবাসী যেমন খুশি হয়েছিল, তাদের ইয়ার-বন্ধুরাও তা নিয়ে মেতে উঠেছিল ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে। ‘লঞ্চের মতো ট্রেনে লম্বা কাঠের সিঁড়ি নেই, তাহলে বরিশালের লোকজন তাতে চড়বে কী করে! মাটির মটকিতে পানি না রাখলেই বা তারা ট্রেনে চড়ে পায়ের কাদা ধুবে কোথায়?’—এসব ইয়ার্কিতে বরিশালবাসীদের সুযোগ পেলেই জ্বালাতন করত তারা। আপাতত বরিশালে রেল যাচ্ছে না, তাই ইয়ার-বন্ধুদের সেসব ইয়ার্কিরও এখন ইতি। বরিশালবাসীদেরও আশার গুড়ে বালি।
বরিশালে রেলগাড়ি কোনো দিন না চললেও, দেশের রেল ইতিহাসে কিন্তু জ্বলজ্বল করছে গর্বিত একটি নাম—‘বরিশাল এক্সপ্রেস’। যে জেলায় কখনো ট্রেন চলল না, সেই জেলার নামে এক্সপ্রেস ট্রেন! গোলমেলে এই ব্যাপারটির সূচনা ১৮৮৪ সালে। গোলমেলে বলা ঠিক নয়—সাহিত্য, রাজনীতি, ফসল উৎপাদন ইত্যাদি বিবেচনায় বরিশাল তখনকার দিনেও গুরুত্বপূর্ণ জেলা। তাই সেই জেলার নামে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের নামকরণ হবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!
তখন অবিভক্ত ভারত, অবিভক্ত বাংলা। বাংলায় প্রথম ট্রেনটি হুইসেল বাজিয়ে চাকা ঘোরাতে শুরু করে ১৮৫৪ সালের ১৫ই আগস্ট। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার। কলকাতার হাতিয়াড়া (বর্তমানে যেটা হাওড়া স্টেশন) থেকে ছাড়ল ট্রেন, যাবে হুগলি পর্যন্ত। মাত্র ২৪ মাইল। তাতে কী! কৌতূহলের পারদ তুঙ্গে। স্টেশন লোকে লোকারণ্য। যাত্রী নয়, কৌতূহলীদের এমন ভিড় যে, নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা আগে ছাড়তে হল ট্রেনটিকে। নইলে সময়মতো পৌঁছাতেই পারত না। লোহা-লক্কড় দিয়ে বানানো একগাদা ‘ঘরবাড়ি’ যে চলতে পারে—চোখে দেখার পরও বিশ্বাস হচ্ছিল না প্রায় কারও। সেদিন তো নয়ই, বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি লোকজনের।
এই ঐতিহাসিক ঘটনার দুই বছর পরের কথা—১৮৫৬ সাল। হাওড়া থেকে ট্রেনে চড়েছিলেন রূপচাঁদ ঘোষ। যাবেন হুগলি। হুগলি নেমে তিনি জনে জনে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, জায়গাটির নাম হুগলি—ঠিক তো? কারণ তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিল না, হাওড়া থেকে এত তাড়াতাড়ি হুগলি পৌঁছানো সম্ভব! পণ্ডিত রাধালঙ্কার বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক জ্যোতিষী অনেক পাঁজি-পুথি ঘেঁটে ট্রেনে উঠেছিলেন। হুগলি নেমে স্টেশনেই বসে নানারকম মন্ত্র যপ করতে শুরু করলেন। আগুনে গাড়িতে আবার চড়লে আয়ু কমে যেতে পারে—এই ভয়ে তিনি বাড়ি ফেরার সময় আর ট্রেনেই চড়েননি।
সে সময় কলকাতার বাসিন্দা জোন্স নামে এক ইংরেজের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না, এত লোহা-লক্কড় দিয়ে বানানো গাড়ি তার ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে বেগে ছুটতে পারে। রেলগাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি তার ঘোড়ার গাড়ি হাকিয়েছিলেন পরপর তিন দিন। এক নাগাড়ে চাবুক মারতে মারতে শেষমেশ মেরেই ফেললেন তার ঘোড়া—তবু লোহা-লক্কড়ের গাড়িকে হারাতে পারেননি।
ট্রেনটিতে ছিল তিনটি শ্রেণি—প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল ৩ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির ১ টাকা ২ আনা, আর তৃতীয় শ্রেণির ভাড়া ৭ আনা।
বরিশাল এক্সপ্রেসের গল্প
আগেই বলা হয়েছে, বরিশাল এক্সপ্রেসের যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৪ সালে। নাম বরিশাল এক্সপ্রেস হলেও সেই ট্রেন বরিশাল যায়নি কস্মিনকালেও। চলাচল করত শিয়ালদহ আর খুলনার মধ্যে, মাঝখানে পেট্রাপোল–বেনাপোল স্টেশন। পূর্ব বাংলা থেকে পাট পরিবহণের বিষয়টি মাথায় রেখে চালু হয় এই ট্রেন। তবে খুলনা থেকে এতে করে কলকাতায় মাছের চালানও যেত বলে জানা যায়। ট্রেনটি ছিল অর্থনৈতিকভাবে লাভজনকও। শিয়ালদহ থেকে খুলনা পৌঁছানোর পর যাত্রীদের নিয়ে একটি স্টিমার বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দিত। সেই স্টিমারের নামও ছিল ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’। পথে বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও নলছিটিতে যাত্রাবিরতি করত। ট্রেনটি চালু ছিল ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের আগে পর্যন্ত তিনটি মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেন চলত। এরপর সব বন্ধ হয়ে যায়। বরিশাল এক্সপ্রেস এখন কেবলই স্মৃতি।
ইতিহাসে ভেসে থাকা এক নাম
বরিশালে কোনো কালে রেলপথ ছিল না। এখানে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, ইতিহাস ঘেঁটে এমন তথ্যও পাওয়া যায় না। কিন্তু এ দেশের রেলওয়ের ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নামক হারিয়ে যাওয়া এক ট্রেনের নাম। এদেশের মাটিতেই সদম্ভ পদভারে ছুটে চলত বরিশাল এক্সপ্রেস। তবে ট্রেনটি বরিশালে যেত না।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণ হচ্ছিল। শিয়ালদহ থেকে দর্শনা হয়ে গোয়ালন্দ ও শিলিগুড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হয়েছে অনেক আগেই। ট্রেন চলাচলের ফলে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠেছে। এদিকে যশোর ও খুলনা অঞ্চল তখন বেশ সমৃদ্ধ। তাই ব্রিটিশ সরকার খুলনা অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে কোম্পানি’। এটি ছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের একটি সহায়ক কোম্পানি। ইউরোপে তখন রেলওয়ে ব্যবসা জমজমাট, ফলে বিনিয়োগ পেতেও অসুবিধা হয়নি। সরকারের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তি হয়, সকল খরচ বাদ দিয়ে লাভের পাঁচ ভাগের একভাগ সরকার পাবে, বাকি থাকবে কোম্পানির। এই কোম্পানির পেছনে ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী পরিবার—রথসচাইল্ড। নাথানিয়েল মায়ের রথসচাইল্ড ছিলেন কোম্পানির অন্যতম স্বত্বাধিকারী।
১৮৮১ সালের জুলাইয়ে রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। প্রথমে রানাঘাট থেকে বনগাঁও, পরে বনগাঁও থেকে যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ শেষ হয় ১৮৮৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি।
যুদ্ধ, বন্ধন ও নতুন ট্রেন
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে বরিশাল এক্সপ্রেস একটি আন্তর্জাতিক ট্রেনে পরিণত হয়। বেনাপোল ও পেট্রাপোলে যাত্রীদের দু’বার পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা হতো। তখন ইস্ট বেঙ্গল মেইল ও ইস্টার্ন বেঙ্গল এক্সপ্রেস নামে আরও দুটি ট্রেন চলত। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে বরিশাল এক্সপ্রেসসহ সব ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘ ৫২ বছর পর, ২০১৭ সালে কলকাতা–খুলনা রুটে ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ নামে নতুন ট্রেন চালু হয়। কিন্তু ‘বরিশাল এক্সপ্রেস’ নামটি আর ফিরে আসেনি।
রেল লাইনের রূপকথা থেকে স্মৃতির পাতায়
বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে বৈদ্যুতিক ট্রেন, হাওড়ার হাতিয়াড়া থেকে আজকের মেট্রোরেল—বাংলার রেল ইতিহাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু বরিশাল এক্সপ্রেসের মতো নাম একটিই। বৈদ্যুতিক পাখাবিহীন সেই সবুজ ট্রেনটি অনেকের স্মৃতিতে আজও জীবন্ত। কালের পরিক্রমায় কিছু জিনিস হারিয়ে যায়, কিন্তু কিছু স্মৃতি ইতিহাসের পাতায় চিরকাল থেকে যায়—বরিশাল এক্সপ্রেস তারই একটি।