পরিবেশ সংরক্ষণে স্থানীয় নেতৃত্বের উত্থান
বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ও জীববৈচিত্র্য করিডোরে একদল ‘কমিউনিটি চ্যাম্পিয়ন’ মানুষের, বন্যপ্রাণীর ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য আনার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করছেন।
গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ)-এর অর্থায়নে পরিচালিত ও বিশ্বব্যাংক-নেতৃত্বাধীন গ্লোবাল ওয়াইল্ডলাইফ প্রোগ্রাম (জিডব্লিউপি) বর্তমানে ৩৮টি দেশে কাজ করছে। এর মূল লক্ষ্য অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্য রোধ, মানুষ-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব হ্রাস এবং বন্যপ্রাণী নির্ভর জীবনধারার প্রসার।
নিচে এমন চারটি দেশের উদাহরণ তুলে ধরা হলো যেখানে স্থানীয় নেতারা প্রকৃতি রক্ষায় সমাজে পরিবর্তন আনছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা: মার্টিন ও জেনি—বন্যপ্রাণীর সহাবস্থানে প্রতিশ্রুতিশীল দুই রক্ষক
ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কে মার্টিন এনকোসি ও জেনি এনকুনা পরিবেশ পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের প্রধান দায়িত্ব হলো বন্যপ্রাণী এবং স্থানীয় মানুষদের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে পর্যবেক্ষণ ও রিপোর্টিং।
মার্টিন বলেন, “আমি গাছের ওষুধ সংগ্রহকারীদের কারণে কিংবা হাতির ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়া মেরামত করি। এতে বন্যপ্রাণী অভ্যন্তরে থাকে, আর গবাদিপশু ও শিকারিরা বাইরে।”
তিনি স্থানীয়দের মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে সচেতনতা তৈরি করছেন।
জেনি জানান, “এই কাজই আমার প্রথম পরিবেশ সংরক্ষণে পদার্পণ। প্রশিক্ষণে আমি নেতৃত্ব ও বন্যপ্রাণীর সঙ্গে আচরণ শেখার সুযোগ পেয়েছি।”
বিদ্যালয়গুলোতে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা সচেতনতা কর্মসূচি চালান এবং বেআইনি বন্যপ্রাণী বাণিজ্য বিরোধী ‘ফান রান’-এ অংশ নেন।
মালি: দজেনেবা—হাতি ও প্রকৃতির রক্ষক
দৌয়েন্তজায় একসময় কাঠকয়লা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন দজেনেবা তাবালাবা। আয়ের পথ সংকুচিত হয়ে এলে তাঁর সন্তানদের স্কুল ছেড়ে দিতে হয়।
জিডব্লিউপি প্রকল্পে তিনি প্রশিক্ষিত ইকো-গার্ড হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ, হাতি গণনা এবং পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে অংশ নেন।
তিনি বলেন, “আমি এখন একটি কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, যেখানে সবজি চাষের জন্য অর্থ সহায়তা পেয়েছি। এখন আমার পরিবার খেতে পাচ্ছে এবং সন্তানদের প্রয়োজন মেটাতে পারছি।”
এই প্রকল্প স্থানীয় জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনছে এবং মানুষ ও হাতির সহাবস্থানের ইতিবাচক ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়া: সুলাইমান—সম্প্রদায়ভিত্তিক সংরক্ষণে অগ্রদূত
সুমাত্রার উত্তরে লুটুয়েং এলাকায় ২০০৯ সাল থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ টেকসই ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব পালন করছেন সুলাইমান।
Fauna & Flora International-এর সঙ্গে মিলে তিনি ফলজ গাছের নার্সারি গড়ে তোলেন (৭০% ফলের গাছ ও ৩০% কাঠের গাছ)।
মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব কমাতে তিনি ‘এলিফ্যান্ট কনফ্লিক্ট কেয়ার কমিউনিটি গ্রুপ’ গঠন করেন, যারা বিদ্যুতায়িত বেড়া দিয়ে ফসল রক্ষা করে। এছাড়া বন রক্ষা ও দ্বন্দ্ব সমাধানে পেট্রোল ইউনিট গঠন করেন।
তিনি বলেন, “যা কিছু করি, সবটাই কমিউনিটির কল্যাণে। এখন অনেকেই আমার কাজকে এগিয়ে নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে।”
ইকুয়েডর: আন্দি—এক তরুণ আদিবাসী নেতা ও পরিবেশ আন্দোলনের পথিকৃৎ
২২ বছর বয়সী আন্দি এডিসন জিম্পিকিট মাশিনকিয়াশ ইকুয়েডরের শুয়ার জাতিসত্তার প্রতিনিধি হিসেবে প্রকৃতি ও সমাজ রক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
১৭ বছর বয়সে তিনি একটি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন এবং মৌমাছি পালন ও পরে স্টিংলেস মৌমাছির মাধ্যমে ভ্যানিলা পরাগায়নে উদ্যোগ নেন।
এখন তাঁর কমিউনিটি মধু সংগ্রহ কেন্দ্র পরিচালনা করছে এবং মাছ, মুরগি ও কোকো চাষ করে আয় বৈচিত্র্য আনছে। এতে বন্যপ্রাণী শিকার কমেছে ও রোগ সংক্রমণ হ্রাস পেয়েছে।
তিনি তরুণদের জৈব চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন ও সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর বোনও এখন বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষক।
বিশ্বজুড়ে প্রকৃতিপ্রেমী সমাজনেতাদের প্রচেষ্টা
মার্টিন, জেনি, দজেনেবা, সুলাইমান ও আন্দির মতো কমিউনিটি চ্যাম্পিয়নরা জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
জিডব্লিউপি এখন পর্যন্ত ৩৮টি দেশে প্রায় ৮ লাখ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে এবং মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সহাবস্থানের সম্ভাবনাময় একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে।