ঘটনার শুরু ১৯০৫ সালে। সে সময় জাটিঙ্গা গ্রামে বাস করত একদল নাগা। সে বছর বর্ষাকালে এক অমাবস্যার রাতে একটি মোষ খুঁজতে বাইরে বেরিয়েছিল নাগারা। মশাল জ্বালিয়ে বরাইল পর্বতশ্রেণির জাটিঙ্গা শৃঙ্গের কাছে গিয়ে মোষ খোঁজার সময় নাকি পাখির মৃতদেহ তাঁদের উপর বৃষ্টির ধারার মতো পড়তে থাকে। কুসংস্কারবশত নাগারা ভেবেছিল যে, অশুভ আত্মার ছায়া পড়েছে তাঁদের ওপর। ফলে এলাকা ছেড়ে চলে যান নাগারা। সেই থেকে সেখানে আজও পাখির মৃতদেহ পড়ার ঘটনাও ঘটে চলেছে।
এই ঘটনার পর নাগারা আর সেই গ্রামে বসবাস নিরাপদ বলে মনে করেনি। অশুভ আত্মা কখন কী করে বসে, তা নিয়ে ভয় ঢোকে তাদের মনে। সকাল হলে গ্রামের সবাই দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে নতুন আশ্রয়ের সন্ধানে। তারা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার সময় আরেকদল পাহাড়ি আদিবাসীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তারাও বেরিয়েছিল নতুন কোনো আশ্রয়ের সন্ধানে। তখন নাগারা তাদের গ্রামে অশুভ আত্মার কুদৃষ্টির কথা বলে। কিন্তু সেই পাহাড়ি আদিবাসীরা একটা পরিত্যক্ত গ্রাম পেয়ে ভীষণ খুশি হয়। তারা সেই গ্রামে এসে বসবাস শুরু করে। এখনও তারাই সেই গ্রামের বাসিন্দা।
১৯১০ সাল নাগাদ আবিষ্কার হয় যে জাটিঙ্গা গ্রামে পাখিদের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয় শুধু সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস নাগাদ। তবে পাখিদের আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্বের সামনে আসে ১৯৫৭ সালে। ব্রিটিশ চা ব্যবসায়ী এবং পক্ষীবিশারদ ই. পি. গি সাহেব ঘটনাটি জানতে পেরে জাটিঙ্গাতে আসেন। তিনি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে একটি বই লেখেন। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত গি সাহেবের বই The Wildlife of India থেকে পৃথিবীর মানুষ প্রথম জানতে পারে জাটিঙ্গা রহস্যের কথা। সেই থেকে পাখিদের রহস্যময় মৃত্যু দেখতে প্রতিবছরই জাটিঙ্গা গ্রামে ভিড় জমান বহু পর্যটক। স্থানীয়রা সেসব মৃত পাখির মাংস খায়। এই ঘটনা যখন ঘটে তখন জাটিঙ্গা গ্রামে সেই সময় রীতিমতো উৎসব শুরু হয়—পাখির মাংস খাওয়ার উৎসব।
পাখিদের এই তথাকথিত আত্মহত্যা নিয়ে বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের মধ্যে টানাপড়েন রয়েছে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ‘দুষ্ট আত্মারা’ উড়ন্ত পাখিদের নামিয়ে আনে। তবে সব পাখি নয়—যে সব পাখি ‘দুষ্ট আত্মাকে’ অপমান করে, শুধু তাদেরই নামিয়ে আনা হয়। রহস্য উদ্ঘাটনে নেমে গবেষকরা দেখেছেন, ‘আত্মঘাতী’ পাখিগুলোর মধ্যে স্থানীয় নানা প্রজাতির পাখি রয়েছে—বক, মাছরাঙা, কালি বক, রাজ বক ইত্যাদি।
‘আত্মহত্যার’ সময় মূলত বর্ষাকাল। কিন্তু কেন? গবেষণা বলছে, বর্ষার শেষ দিকে অসমের অধিকাংশ জলাশয়ই পূর্ণ থাকে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু জল আর জল। বেশিরভাগ সময়ই অসমে বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই পরিস্থিতিতে পাখিরা নিজেদের বাসা হারিয়ে ফেলে। নতুন বাস খুঁজতে তারা পাড়ি দেয় অন্য এলাকায়। অন্য এলাকায় যাওয়ার পথেই তারা ‘আত্মহত্যা’ করে। ১৯৮৮ সালে অসমে ভয়ঙ্কর বন্যার সময় এত পাখি আত্মহত্যা করেছিল যে, তা কল্পনারও বাইরে। যদিও পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে নাকি ‘আত্মহত্যার’ প্রবণতা দেখা দেয় না।
গবেষকরা বলছেন, দূর থেকে উড়ে আসার সময় জাটিঙ্গা গ্রামের আলো দেখে পাখিরা এসে নামে। আর এই গ্রামে এসেই যেন হঠাৎ দিশাহারা হয়ে পড়ে পাখির দল। অজানা দুঃখে প্রাণ ত্যাগ করে। অনেকের দাবি, কুয়াশার কারণে এরা দিশাহারা হয়ে পড়ে। তখন বড় বড় গাছ বা শক্ত কোনো কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সেই সময় গ্রামবাসীরা বাঁশ বা লাঠি দিয়ে পাখিদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই ঘটনা তো বিশ্বের যে কোনো স্থানেই ঘটতে পারে। রাতের বেলা আলো তো সব গ্রামেই জ্বলে, শীতের সময় কুয়াশা তো পড়বেই—তাহলে জাটিঙ্গাতেই কেন এমন ঘটে? এর উত্তর এখনও বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি।
জানা যায়, জাটিঙ্গা গ্রামে প্রায় ৪৪ প্রজাতির পাখি এই ধরনের অদ্ভুত আচরণ করে। এই পাখিগুলো মূলত উত্তর দিকে থেকে আসে। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, এর মধ্যে কোনো পরিযায়ী পাখি থাকে না। সবই প্রায় আশপাশের উপত্যকা বা পাহাড়ি এলাকা থেকে উড়ে আসা পাখি। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে শয়ে শয়ে পাখি গ্রামে নেমে আসে। তার পর দ্রুত গতিতে কোনো বাড়ি বা গাছের দিকে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে প্রাণ হারায়। গ্রামের বিশেষ দেড় কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই এমন ঘটে।
পাখিদের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ এখনও জানা না গেলেও কোনো কোনো গবেষকের দাবি, এই ঘটনা আসলে গ্রামবাসীদের কারসাজি। বর্ষায় বন্যার ফলে ফসল নষ্ট হয়ে যায় বলে গ্রামে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সেই সময় পাখির মাংসই তাদের খাদ্যাভাব পূরণ করে। অন্ধকার নামলে লন্ঠন বা অন্য কোনো আলো দেখিয়ে তারা পাখিদের আকর্ষণ করে। পাখি আলো দেখে দ্রুত নেমে এলে তাদের পিটিয়ে মারা হয়। নিজের গবেষণাপত্রে এমনই দাবি করেছেন অসমের বিখ্যাত পক্ষী বিশারদ আনোয়ারউদ্দিন চৌধুরী।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিজ্ঞানীরা জাটিঙ্গায় গিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণা এখনও চলছে। ১৯৭৭ সালে জাটিঙ্গাতে আসেন জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষীবিশেষজ্ঞ ডঃ সুধীন সেনগুপ্ত। পাখিদের আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে তিনি উদ্যোগী হন। তিনি দাবি করেন যে, এর পিছনে আবহাওয়া এবং বায়ুচাপের আকস্মিক পরিবর্তন, ভূ-চুম্বক, মাধ্যাকর্ষণ টান এবং উপত্যকায় বিদ্যুতক্ষেত্রে গোলযোগের কারণ রয়েছে। তাঁর মতে, জাটিঙ্গা পাহাড়ের চূড়ার পাথরে রয়েছে উচ্চশক্তির চুম্বকীয় খনিজ পদার্থ এবং উপত্যকার নিচে বর্ষার পর মাটিতে বেড়ে যাওয়া জলের স্তর একত্রিত হয়ে এলাকার মাধ্যাকর্ষণ এবং চুম্বকশক্তির অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পাহাড়ের সদা পরিবর্তনশীল আবহাওয়া। এ সবের প্রভাব পড়ে পাখিদের স্নায়ুতন্ত্রের উপর। ফলে তারা আত্মহত্যা করে। ডঃ সুধীন সেনগুপ্তের গবেষণার সঙ্গে সহমত হয়েছেন ব্রিটিশ পক্ষী বিশেষজ্ঞ ফিলিপ গ্র্যান। অবশ্য শুধু জাটিঙ্গাতেই নয়, পাখিদের এই অদ্ভুত আচরণ দেখা যায় ফিলিপাইন এবং মালয়েশিয়ার মতো দেশের কিছু কিছু এলাকাতেও।