শুধু পাশ করলেই চলবে? শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বে প্রশ্ন
বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্প্রতি ব্যাপকভাবে ‘অটো পাস’ বা পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই উত্তীর্ণ হওয়ার দাবি উঠেছে। উপাচার্যের (ভিসি) দপ্তরের সামনে আন্দোলন, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ — সব জায়গায়ই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে শিক্ষার্থীদের এই দাবি। এই বাস্তবতা একটি বড় প্রশ্ন তোলে: কেন শিক্ষার্থীরা শেখার চেয়ে ফলাফল পাওয়ার নিশ্চয়তায় বেশি আগ্রহী? কেন তারা ভবিষ্যতের কর্মজীবন, দক্ষতা ও জ্ঞানের গুরুত্ব অনুধাবন করছে না?
কলেজ শিক্ষার্থীদেরও একই দাবি, সরকার মেনেছে অংশত
এই মনস্তত্ত্ব নতুন কিছু নয়। এর আগেও একই ধরনের পরিস্থিতির জন্ম হয়েছিল। বিশেষ করে ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ছাত্র আন্দোলনের পর, যখন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে অংশ না নিয়ে পাশ করার দাবি তোলে। সেই সময়ে আন্দোলনের চাপ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে সরকার কিছু বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল করে বিকল্প মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করে। এর আগেও ২০২০–২১ শিক্ষাবর্ষে কোভিড মহামারির সময় এইচএসসি শিক্ষার্থীদের কিছু বিষয়ের পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। তাতে অনেকেই পাশ করলেও বাস্তবে তাদের শিক্ষণের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই নজিরই আজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে একটি ‘দাবি করলেই মেলে’ মানসিকতা গড়ে তুলছে বলে শিক্ষাবিদদের পর্যবেক্ষণ করে।
ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক বলেন,
“এটা এখন একটি প্রবণতা হয়ে গেছে — যে যেখানে আন্দোলন করে, সেখানেই ছাড় পাওয়া যায়। এতে প্রকৃত শিক্ষা, নৈতিকতা আর চেষ্টার মূল্য হারিয়ে যাচ্ছে।”
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবি কী?
বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করছে, দীর্ঘ সেশনজট, অনলাইন ক্লাসের অকার্যকারিতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ — সব মিলিয়ে তাদের পক্ষে কঠিন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা চাইছে, “একবারের জন্য হলেও” সবাইকে পাশ করিয়ে দেওয়া হোক। সাম্প্রতিক আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা বলেন:
“আমরা দুই বছর ধরে প্রতিনিয়ত উদ্বেগে ছিলাম। ক্লাস হয়নি ঠিকভাবে, কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। আমাদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেছে।”
মনস্তত্ত্ব: ফলাফল-ভিত্তিক মানসিকতা বনাম শেখার আগ্রহ
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের এই মনোভাব একটি গভীর মানসিক ও সামাজিক প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়। এটি কেবল একজন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নয় — সমগ্র সমাজে শিক্ষার প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, তার প্রতিফলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড. ফারহানা রওশন বলেন,
“আমরা শিক্ষাকে সনদপ্রাপ্তির মাধ্যম হিসেবে ভাবি। অভিভাবকরা বলেন, ‘পাশ করো, চাকরি পাবে।’ শিক্ষকরা বলেন, ‘গ্রেড ভালো হলে ভবিষ্যৎ ভালো।’ কোথাও শেখার আনন্দ বা প্রকৃত জ্ঞানের কথা বলা হয় না। এর ফলেই শিক্ষার্থীরা পাশকে চূড়ান্ত লক্ষ্য ধরে নেয়।”
কর্মজীবনের ভবিষ্যৎ কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ‘অটো পাস সংস্কৃতি’ ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। কারণ বর্তমান চাকরি বাজারে কেবল সার্টিফিকেট নয়, জ্ঞান, দক্ষতা ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা জরুরি। একজন টেক কোম্পানির মানবসম্পদ প্রধান বলেন,
“একজন গ্র্যাজুয়েট যদি প্রকৃত জ্ঞান ছাড়াই পাস করে, চাকরি পেতে না পারা তো এক সমস্যা, চাকরি ধরে রাখতে কঠিন হয়ে যায়।”
শিক্ষকদের বক্তব্য
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলছেন, পরীক্ষার ফলাফলের চাপ অবশ্যই বাস্তব, কিন্তু সেটার সমাধান ‘অটো পাস’ নয়। বরং দরকার মূল্যায়ন পদ্ধতি আরও মানবিক করা, শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত প্রস্তুতির সুযোগ দেওয়া।
উপাচার্যের অবস্থান
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন,
“আমরা শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ ও হতাশা বুঝি। তবে শিক্ষার মান রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানের দিকে যাচ্ছি।”
শিক্ষা শুধু পাশ করার জন্য নয়, বরং শেখার জন্য। অতীতে কলেজ পর্যায়ে কিছু বিষয়ের পরীক্ষা বাদ দেওয়া, কোভিডকালীন ‘অটো পাস’, আর ২০২৩ সালের জুলাই আন্দোলনের পর সৃষ্ট উদাহরণ — সব মিলে একটি ট্রেন্ড স্পষ্ট করছে। এই প্রবণতা যদি থামানো না যায়, তাহলে ভবিষ্যতের কর্মক্ষমতা, গবেষণা, উদ্ভাবন এবং জাতীয় উন্নয়নের গতিই বাধাগ্রস্ত হবে। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবার ও শিক্ষার্থীদের সবাইকে এ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে — শিক্ষা কি শুধু পাশ করার নাম, নাকি ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে গড়ে তোলার প্রস্তুতি?