এক সময়ের উপকূলীয় রত্ন
কক্সবাজারের চকরিয়া ও মহেশখালী অঞ্চলে এক সময় বিস্তৃত ছিল একটি ঘন ম্যানগ্রোভ বন, যেটিকে স্থানীয়রা ‘চকরিয়ার সুন্দরবন’ নামে ডাকত। বৃটিশ আমল থেকে এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এটি ছিল একটি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখত।
এ বনের গাছে গাছে ছিল গেওয়া, কেওড়া, গোলপাতা ও গর্জন—যার ছায়ায় জন্মাতো বন্য প্রাণী ও উপকূলীয় পাখিরা। এই বন উপকূলবাসীর জীবিকার সাথেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু আজ সেখানে শুধু লবণ মাঠ, চিংড়ির ঘের আর শিল্প স্থাপনার কাঠামো।
ব্রিটিশ গেজেট ও ঐতিহাসিক মানচিত্রের সাক্ষ্য
বৃটিশ আমলের বন গেজেট ও মানচিত্রে চকরিয়া-মহেশখালী উপকূলজুড়ে বিস্তৃত একটি সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনের উল্লেখ রয়েছে। স্বাধীনতার পর এই বন বন বিভাগ পরিচালিত উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্পের অংশ হলেও ১৯৮০-এর দশক থেকে তা বিপন্ন হতে থাকে।
ধ্বংসের পথরেখা
লবণ ও চিংড়ি চাষ:
১৯৮০-২০০০ সালের মধ্যে হাজার হাজার একর বনভূমি উজাড় করে চিংড়ি ও লবণ চাষের ঘের বানানো হয়। এতে ভূমির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় গাছপালা আবার জন্মানোর পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়।
উন্নয়ন প্রকল্প:
মহেশখালীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর এবং রেলপথ নির্মাণের নামে বনভূমি কেটে ফেলা হয়। বন বিভাগের জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে রাস্তা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়।
রাজনৈতিক দখল সংস্কৃতি:
বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে সরকারি খাসজমি দখল হয়ে যায়। গুচ্ছগ্রাম, পুনর্বাসন প্রকল্প কিংবা পোলট্রি খামারের নামে বনভূমি বেসরকারি দখলে চলে যায়।
জীববৈচিত্র্যের পতন
এই বনে ছিল বানর, শূকর, গুইসাপ, সাপ, বন্য হাঁসসহ অনেক প্রাণী। বনভূমি ধ্বংসের ফলে এসব প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। নদীর মাছ কমেছে, পাখি কমেছে, এবং উপকূলের প্রতিবেশ আজ বিপন্ন। ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে যে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা একসময় ছিল, তা এখন নেই।
স্থানীয়দের অভিমত
মহেশখালীর স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন,
“আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বিশাল জঙ্গল, যেখানে বনের ধারে গোলপাতা কাটা হতো। এখন এসব কিছু নেই। বরং দখলের ভয়, মামলা আর প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা আছে।”
অন্য একজন প্রবীণ বাসিন্দা জানান, “সিন্ডিকেট করে বন কেটে ফেলা হয়েছে। অথচ সরকার তখন চুপ ছিল।”
স্থানীয়রা আজ বনভূমি ফেরত চায়, তবে তারা জানে না কীভাবে শুরু হবে পুনরুদ্ধার।
বন বিভাগের তথ্য
বন অধিদপ্তরের উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, ১৯৬০-এর দশকে চকরিয়া ও মহেশখালীতে প্রায় ২০,০০০ হেক্টর জমিতে ম্যানগ্রোভ বন ছিল। বর্তমানে সেটি ৫,০০০ হেক্টরেরও নিচে নেমে এসেছে। বন বিভাগ স্বীকার করেছে যে অবৈধ দখল, উন্নয়ন প্রকল্প এবং পরিবেশগত পরিবর্তন এই হ্রাসের জন্য দায়ী।
পরিবেশবিদদের সতর্কতা
পরিবেশবিদ ড. জামাল হোসেন বলেন,
“চকরিয়ার ম্যানগ্রোভ বন শুধু পরিবেশ রক্ষা করত না, এটি ছিল উপকূলের ‘লাইফলাইন’। আজ তা নেই, ফলে ঝুঁকি বহুগুণে বেড়েছে। যদি এখনই বন পুনর্গঠনের উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতের চকরিয়া-মহেশখালী আর বাসযোগ্য থাকবে না।”
তিনি আরও বলেন, পুনর্বনায়নের জন্য স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে কাজ করতে হবে, যাতে তারা লাভবান হয় এবং বন রক্ষার জন্য উৎসাহী হয়।
পুনরুদ্ধারের পথ কী?
- বন আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ
- পুরনো মানচিত্র অনুসারে জমি পুনরুদ্ধার
- মানবসম্পৃক্ত বনায়ন প্রকল্প চালু
- বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে দখল রোধ
- উপকূলীয় পরিবেশ উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা
বাস্তবে চকরিয়া-মহেশখালী উপকূলের হারিয়ে যাওয়া সুন্দরবন শুধু একটি বনভূমি নয়, এটি ছিল উপকূলবাসীর জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ সেটি কেবল ইতিহাস, অথচ এর অনুপস্থিতি আগামী প্রজন্মের জন্য ভয়ংকর ঝুঁকি তৈরি করছে। সময় থাকতে ফিরে দেখা জরুরি—উন্নয়ন চাই, কিন্তু প্রকৃতির বিনাশ নয়।