তারাপদ রায় বাঙালি সাহিত্যে এক স্বতন্ত্র স্থাপন করে গেছেন—হাস্যরসাত্মক উপন্যাস থেকে গ্রহণা-অগ্রহণা কবিতায় তাঁর স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সরাসরি সম্পর্কিত টাঙ্গাইলের মাটি ও মানুষের স্মৃতিগুলো তাঁর লেখালেখিতে অদ্যাবধি প্রতিফলিত হয়। শৈশবে টাঙ্গাইলের গ্রামের খোলা মাঠ, নদীর তীরে কাটানো মুহূর্তগুলো এবং ‘বিন্দুবাসিনী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়’-এ পড়াশোনার দিনগুলো তাঁর মননে গেঁথে আছে; পরবর্তীতে সেই সব অমল স্মৃতিই তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাণ যোগায়।
১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল জেলার একটি ক্ষুদ্র গ্রামচরে তাঁর জন্ম হয়—অর্থাৎ টাঙ্গাইলের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগের সূত্রপাত সেইদিন থেকেই ।
টাঙ্গাইলের স্মৃতি
তরুণ বয়সে টাঙ্গাইলের বিদ্যালয় জীবন শেষ করে নতুন স্বপ্ন আঁকতে কলকাতার পথে রওনা হন তিনি। ‘বিন্দুবাসিনী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়’- থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫১ সালের শীতে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এরপর সেন্ট্রাল কলকাতা কলেজে (বর্তমানে মাওলানা আজাদ কলেজ) অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন।
সে-টাঙ্গাইলের গ্রামবাংলার আবহ তাঁকে ছাড়েনি; এর প্রমাণ মেলে পরবর্তী সময়ে লেখা ছোটগল্প ও কবিতায়—যেখানে সরল জীবনের গভীরতম অনুভূতিগুলো নিয়মিত ফিরে এসেছে। নদী-ঘাটের জীবন্ত দৃশ্য, আকাশে ডাকপাখির ডাক, বর্ষার জলধারণ—সবকিছুই তাঁর রচনায় যেন শ্বাস ফেলে। তাঁর তরুণবয়সের টাঙ্গাইলের চিত্রাবলী যেমন দেখা যায় তাঁর প্রথম কবিতাসঙ্কলন ‘তোমার প্রতিমা’ (১৯৬০)-এ, তেমনই পরবর্তী দীর্ঘ রচনাসমূহেও পাওয়া যায় পূর্ববাংলার স্মৃতি আর উত্তেজনাপূর্ণ নস্টালজিয়া ।
সাহিত্যিক জীবন
কলকাতায় বসবাসের পর থেকেই তারাপদ রায় বিদ্রূপাত্মক নান্দিক আবেগকে আলিঙ্গন করে বলতে শুরু করেন, “এই সমাজের হাস্যরস ও বিদ্রূপের মধ্যেই বাঙালি চেতনার সূক্ষ্মটান লুকিয়ে আছে।” তাঁর সাহিত্যকর্ম মূলত কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকথা ও উপন্যাসের সমন্বয়। প্রথম কবিতাসঙ্কলন ‘তোমার প্রতিমা’ (১৯৬০) প্রকাশের পর ‘কৃত্তিবাস’-এর তরুণ কবি-সম্ভাগে নাম লেখান তিনি । ‘কৃত্তিবাস’ গ্রুপের সদস্য হিসেবে ১৯৫০-এর দশকে বাংলা কবিতার চিত্রকল্প পাল্টে দেন; বিশেষ করে আধুনিকতার সূত্র ধরে সামাজিক দায়িত্ববোধের সঙ্গে মূল্যবোধের খোঁজ নিয়ে তাঁর রচনাশৈলী প্রকাশ পায়।
কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প ও উপন্যাসে তিনি বিশেষ স্থান করে নেন। মৃত্যুকালে পর্যন্ত প্রায় ৮৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নামের মোড়কে—এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- ‘চরাবাড়ি পরাবাড়ি’ (উপন্যাস)
- ‘নীল দিগন্তে এখন মায়াজিক’ (ভ্রমণকথা)
- ‘কান্ডোগ্যাণ’ (গদ্যসংকলন)
- ‘বিদ্যা বুদ্ধি’ (গ্রন্থ)
- মান্ধতা
এছাড়া ‘দোদো টাটাই পালকাহিনী’, ‘ভদ্রলোক’, ‘মন্দহাতা’, ‘বুদ্ধিশুদ্ধি’, ‘জ্ঞান গুমোয়ী’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো বাংলা সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে ([Bengal Info][1])। তাঁর রচনাশৈলীতে দেখা যায় ব্যঙ্গাত্মক সূক্ষ্মতা, সামাজিক ত্রুটির চিত্রণ, এবং সেই সঙ্গে পুরনো দিনের কুম্ভকারখানার সৌন্দর্যময় জীবনযাপন—সত্যের মিশ্রণে সাজানো কল্পনার এক অনন্য মিশ্রণে গড়ে ওঠা তাঁর সাহিত্যপ্রবাহ।
উল্লেখযোগ্য রচনা ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
তারাপদ রায় যখন কবিতা রচনা করতেন, তখন তাঁর প্রেম, ক্রোধ ও যন্ত্রণার অনুভূতিগুলো উজ্জ্বলভাবে প্রকাশ পেত। ‘পাতা ও পাখিদের আলাচনা’ (১৯৭৫) কাব্যগ্রন্থে বর্ষাকালে নদীতীরের নির্জনতা এবং মানুষের সংগ্রাম একই সঙ্গে ফুটে উঠে; তুলনামূলক নীরব-কবি তাঁর কাব্যিক স্বত্বার মাধ্যমে এক অচেনা রূপে সংবাদ দিতেন। অনেক সময় রাজনীতি-সমাজের বিপর্যয়ের উপরে তাঁর তীক্ষ্ণ প্রতিবাদী কণ্ঠ কাব্যভাষায় ফুটে উঠতো, যা পাঠককে ভাবিয়ে তুলত।
ছোটগল্পগুলোতেও তাঁর হাস্যরস ও বিদ্রূপের কমতি ছিল না। ‘কান্ডজ্ঞান’ বা ‘বিদ্যা বুদ্ধি’-তে অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞাত দিকদর্শন, পশুপাখি, মানুষ-মূল্যবোধ, গ্রামবাংলার টিনের ঘরকুটিরের দৃশ্যাবলী—সব মিলিয়ে একটি ব্যাপক সামাজিক বিশ্লেষণ ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। “ছিলাম ভালোবাসার নীল পতাকাতলে স্বাধীন” (১৯৬৭) কবিতাটি যেমন প্রেমের আবেগের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির সংমিশ্রণে নির্মিত, তেমনই “দারিদ্ররেখা” (১৯৮৬)-তে গণমানুষের দুর্দশা আর সহমর্মিতায় ভরা বার্তাগুলো বিশেষভাবে লক্ষণীয় ।
তার রচনায় দেশ বিভাজনের আঘাত স্পষ্ট; পূর্ববঙ্গের স্মৃতি, নিগারাকালীন দায়িত্ববোধ, আতঙ্ক এবং নতুন জীবনে অস্তিত্বের খোঁজ—এসব বিষয় কবিতা ও ছোটগল্পে কোমলভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তাঁর রচনাগুলো পাঠক সমাজে বাঙালির আত্মার গভীরতম সুর হয়ে থেকে গেছে।
তার কবিতায় উদাহরণ: “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে”
উপরোক্ত বিষয়গুলোর আলোকে বিশেষভাবে একটি কবিতা তুলে ধরলে বোঝা যায় তারাপদ রায়ের বিদ্রূপাত্মক বোধ এবং সরল জীবনের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ একত্রে গড়ে তোলে রসালো বিষয়বস্তু। নিচে সম্পূর্ণরূপে “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে” কবিতাটি সংযুক্ত করছি—যেখানে গ্রামের বিভিন্ন ঘটনা, ভুল বোঝাবুঝি, আর তার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজস্ব সাবজেক্টিভ বোধের শ্বাসরুদ্ধকর হাস্যরস ফুটে ওঠে । মিলে যায় বার বার বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্গে। বাঙালি বার বার এমনি বানর লাঠিকে কৃষ্ণচূড়া ভেবেছে।
আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে
তারাপদ রায়
আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া ভেবেছিলাম,
যার উদ্দেশে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাইবাবু বললেন, ‘ঐটি বানরলাঠি গাছ।’
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বকলস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডট্ পেন হয়ে গেছে
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
টাঙ্গাইলের জন্য তাঁর অবদান ও স্মরণ
টাঙ্গাইলের মানুষ তারাপদ রায়কে কখনো ভুলতে পারে না। কারণ তিনি শুধু টাঙ্গাইলের জন্মভূমি ও শৈশবের বর্ণনা করেননি, বরং সেই অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, নদী জীবন, জমিজমা নিয়ে মনোমুগ্ধকর চিত্রাঙ্কন উপহার দিয়েছেন। তাঁর ছোটগল্প ‘টুবেশিশুর বাবা’ (১৯৯৫)-তে গ্রামীণ বাবার কথা ফুটে ওঠে—গ্রামের মানুষের বিনিময়াত্মক সম্পর্ক এবং জীবনধারার প্রতি গভীর অন্তরঙ্গ শ্রদ্ধা।
টাঙ্গাইল সাহিত্যসংস্কৃতিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন প্রতিচ্ছবি দিয়ে—আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরে। আজ যতবার কেউ টাঙ্গাইলের গ্রামাঞ্চলে যায়, তারাপদ রায়ের স্মরণে ভেসে ওঠে তাঁর ভ্রমণকথা ‘নীল দিগন্তে এখন মায়াজিক’-এ বর্ণিত দৃশ্যপট; সে স্থান পাঠককে সময়ের সঙ্গে নিয়েই অদ্ভুত এক ভ্রমণে নিয়ে যায়। তরুণ লেখকরা আজও টাঙ্গাইলের গ্রামীণ পরিবেশ দেখে অনুপ্রাণিত হন তাঁর রচনাবলী থেকে; ঐ ভাবনাটি হাওর-বাওর, ধানক্ষেত ও কাশফুলের সৌন্দর্যকে উদযাপন করে ।
তাঁর ব্যক্তিত্ব, আন্তরিক সাহিত্যচেতনা ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে টাঙ্গাইলের সাহিত্য-সংগঠন ও তরুণ কবি-লেখকদের সজীব করেছেন। মাঝে মাঝে সরাসরি টাঙ্গাইল গিয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে; পাঠক সংগঠনের সঙ্গে মেলামেশাও করতেন। এভাবেই টাঙ্গাইল ও কলকাতা—দুটি বাংলার মাঝে সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছিল তারাপদ রায়ের জীবনজুড়ে।
তারাপদ রায় বাংলা সাহিত্যের এক দীপ্তিমান নক্ষত্র, যাঁর জন্মস্থান টাঙ্গাইল তে আজীবন অনুপ্রাণিত করে রেখেছিল। শৈশব-কৈশোরের গ্রামীণ রূপ-ছবি তাঁর অভ্যন্তরীণ হৃদয়কে সজীব রেখেছিল—যা পরবর্তীকালে কবিতা, প্রবন্ধ ও ভ্রমণকথার মাধ্যমে বাঙালি পাঠকসমাজকে স্পর্শ করেছে। টাঙ্গাইলের মাটিকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি সেই স্মৃতির জাদুগুলোকে প্রতিটি কলমের পটভূমি হিসেবে নিয়েছিলেন। একুশের বাংলা, বাংলা সাহিত্যের গণমানুষের সুর, সামাজিক বাস্তবতার তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ—এসবের মধ্য দিয়ে তিনি আজও বাংলাভাষীর অন্তরে বেঁচে আছেন। টাঙ্গাইলের মানুষ তাঁর সাহিত্যে চেনে তাদের নিজের মুখ—নদী, বাঁশঝাড়, ছেলে-মেয়েদের খেলা আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা। এ কারণেই টাঙ্গাইল ও তারাপদ রায়—এ দু’জনের মিলিত সুর বাংলার সাহিত্যে স্বতন্ত্র ও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ।