০১:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯৮)

  • Sarakhon Report
  • ১০:০০:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫
  • 50

নজরুল

একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। এই উপলক্ষে ফরিদপুরে আসিয়াছেন প্রচারের জন্য! আমি হাসিয়া অস্থির, “কবিভাই, বলেন কি? কত জায়গায় আপনাকে এ দেশে গোঁড়া মুসলিমসমাজ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ভোটযুদ্ধে তাঁরাই হলেন সব চাইতে বড় সৈন্যসামন্ত। আমাদের সমাজ কিছুতেই আপনাকে সমর্থন করবে না।”

কবি তখন তাঁর সুটকেস হইতে এক বান্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এই দেখ, পির বাদশা মিঞা আমাকে সমর্থন করে ফতোয়া দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের এত বড় বিখ্যাত পির যা বলবেন, মুসলিমসমাজ তা মাথা নিচু করে মেনে নেবে। জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয় সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বইটি ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই তাহলেই কেল্লাফতে। নির্বাচিত আমি তো হবই, নির্বাচিত হলে মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।”

রাতের অন্ধকারে তখন আকাশে অসংখ্য তারা উঠিয়াছে। আমরা দুই কবি মিলিয়া তাদেরই সঙ্গে বুঝি প্রতিযোগিতা করিয়া মনের আকাশে অসংখ্য তারা ফুটাইয়া তুলিতেছিলাম।

কেন্দ্রীয় সভার ভোট-গ্রহণের আর মাত্র দুদিন বাকি। ভোর হইলেই আমরা দুইজনে উঠিয়া ফরিদপুর মৌলবী তমিজউদ্দীন খানের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তমিজউদ্দীন সাহেব আইন-সভার নিম্ন পরিষদের সভ্যপদের প্রার্থী ছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব। আমরা লাল মিঞা সাহেবের সমর্থক ছিলাম। বাদশা মিঞা তমিজউদ্দীন সাহেবকে সমর্থন করিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন। সেইজন্য আমাদের বিশ্বাস ছিল, তমিজউদ্দীন সাহেবের দল নিশ্চয়ই কবিকে সমর্থন করিবেন। কারণ বাদশা মিঞাও কবিকে সমর্থন করিয়া ইতিপূর্বে ফতোয়া দিয়াছেন। আর লাল মিঞার দলে তো আমরা আছিই। সুতরাং সবাই কবিকে সমর্থন করিবে।

কবিকে সঙ্গে লইয়া যখন তমিজউদ্দীন সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তমিজউদ্দীন তাঁহার সমর্থক গুণগ্রাহীদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবার সাজাইয়া বসিয়াছিলেন। কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোট অভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দীন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, “তুমি তো কাফের। তোমাকে কোনো মুসলমান ভোট দিবে না।”

তমিজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমাদের শত মতভেদ থাকিলেও তিনি বড়ই ভদ্রলোক। কবিকে এরূপ কথা বলায় তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। কবি কিন্তু একটুও চটিলেন না।

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চাইতে কঠিন কথাও আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে আপনাদের তীক্ষ্ণ কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।”

সবাই তখন কবিকে ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাঁহার ‘মহরম’ কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোক কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তাঁরই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল। কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন-যে কাজে আমরা আসিয়াছি, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নাই। আমি কবির কানে কানে বলিলাম, “এইবার আপনার ইলেকশনের কথা ওঁদের বলুন।”

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-১৯৮)

১০:০০:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ জুন ২০২৫

নজরুল

একদিন গ্রীষ্মকালে হঠাৎ কবি আমার পদ্মাতীরের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত। তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সভ্য হইবার জন্য দাঁড়াইয়াছেন। এই উপলক্ষে ফরিদপুরে আসিয়াছেন প্রচারের জন্য! আমি হাসিয়া অস্থির, “কবিভাই, বলেন কি? কত জায়গায় আপনাকে এ দেশে গোঁড়া মুসলিমসমাজ কাফের বলে ফতোয়া দিয়েছেন। ভোটযুদ্ধে তাঁরাই হলেন সব চাইতে বড় সৈন্যসামন্ত। আমাদের সমাজ কিছুতেই আপনাকে সমর্থন করবে না।”

কবি তখন তাঁর সুটকেস হইতে এক বান্ডিল কাগজ বাহির করিয়া আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এই দেখ, পির বাদশা মিঞা আমাকে সমর্থন করে ফতোয়া দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের এত বড় বিখ্যাত পির যা বলবেন, মুসলিমসমাজ তা মাথা নিচু করে মেনে নেবে। জসীম, তুমি ভেবো না। নিশ্চয় সবাই আমাকে ভোট দেবে। ঢাকায় আমি শতকরা নিরানব্বইটি ভোট পাব। তোমাদের ফরিদপুরের ভোট যদি আমি কিছু পাই তাহলেই কেল্লাফতে। নির্বাচিত আমি তো হবই, নির্বাচিত হলে মাঝে মাঝে আমাকে দিল্লি যেতে হবে। তখন তোমরা কেউ কেউ আমার সঙ্গে যাবে।”

রাতের অন্ধকারে তখন আকাশে অসংখ্য তারা উঠিয়াছে। আমরা দুই কবি মিলিয়া তাদেরই সঙ্গে বুঝি প্রতিযোগিতা করিয়া মনের আকাশে অসংখ্য তারা ফুটাইয়া তুলিতেছিলাম।

কেন্দ্রীয় সভার ভোট-গ্রহণের আর মাত্র দুদিন বাকি। ভোর হইলেই আমরা দুইজনে উঠিয়া ফরিদপুর মৌলবী তমিজউদ্দীন খানের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। তমিজউদ্দীন সাহেব আইন-সভার নিম্ন পরিষদের সভ্যপদের প্রার্থী ছিলেন। তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বী ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব। আমরা লাল মিঞা সাহেবের সমর্থক ছিলাম। বাদশা মিঞা তমিজউদ্দীন সাহেবকে সমর্থন করিয়া ফতোয়া দিয়াছিলেন। সেইজন্য আমাদের বিশ্বাস ছিল, তমিজউদ্দীন সাহেবের দল নিশ্চয়ই কবিকে সমর্থন করিবেন। কারণ বাদশা মিঞাও কবিকে সমর্থন করিয়া ইতিপূর্বে ফতোয়া দিয়াছেন। আর লাল মিঞার দলে তো আমরা আছিই। সুতরাং সবাই কবিকে সমর্থন করিবে।

কবিকে সঙ্গে লইয়া যখন তমিজউদ্দীন সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তমিজউদ্দীন তাঁহার সমর্থক গুণগ্রাহীদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবার সাজাইয়া বসিয়াছিলেন। কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোট অভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দীন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, “তুমি তো কাফের। তোমাকে কোনো মুসলমান ভোট দিবে না।”

তমিজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমাদের শত মতভেদ থাকিলেও তিনি বড়ই ভদ্রলোক। কবিকে এরূপ কথা বলায় তিনি খুবই মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। কবি কিন্তু একটুও চটিলেন না।

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চাইতে কঠিন কথাও আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে আপনাদের তীক্ষ্ণ কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।”

সবাই তখন কবিকে ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাঁহার ‘মহরম’ কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোক কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তাঁরই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল। কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন-যে কাজে আমরা আসিয়াছি, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নাই। আমি কবির কানে কানে বলিলাম, “এইবার আপনার ইলেকশনের কথা ওঁদের বলুন।”

 

চলবে…..