১২:৩৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫
  • 60

নজরুল

আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরূপে দেখিয়া কবি কত সুখী হইলেন। তিনি আমার কানে কানে বলিলেন, “মায়েরা ছেলেদের প্রতি যে স্নেহ-মমতা ধারণ করে, তোমার চোখে-মুখে সমস্ত অবয়বে সেই স্নেহ-মমতার ছাপ দেখতে পেলাম।”

কবি আসিয়াই তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ভাবে ছেলেদের সামনে কবিতা-গান আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। ক্লাস ছিল, ঘণ্টাখানেক থাকিয়া আমি চলিয়া গেলাম।

দুপুরবেলা ক্লাস করিতেছি-দেখিলাম, ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। মেয়েরা সবাই অনুপস্থিত। কারণ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, ফজলুল হক হলে নজরুল আসিয়াছেন। সবাই তাঁহার বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছে। বেলা তিনটার সময় ফজলুল হক হলে গিয়া দেখি, ছেলেমেয়েদের চাহিদা অনুসারে কবি গানের পর গান গাহিয়া চলিয়াছেন, কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিয়াছেন। কবির মুখ শুদ্ধ; সমস্ত অঙ্গ ক্লান্তিতে ভরা। খোঁজ লইয়া জানিলাম-সেই যে সকাল দশটায় কবি আসিয়াছেন, বারোটা পর্যন্ত মুসলিম হলে থাকিয়া তারপর ফজলুল হক হলে আগমন করিয়াছেন-ইহার মধ্যে কয়েক পেয়ালা চা আর পান ছাড়া কিছুই কবিকে খাইতে দেওয়া হয় নাই। আমার তখন কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই অবুঝ বয়স্ক-শিশুটিকে লইয়া ছেলেরা কি নিষ্ঠুর খেলাই না খেলিতেছে। কিন্তু তখন অবেলায় কোথাও কিছু খাবার পাইবার উপায় ছিল না। আমি এক রকম জোর করিয়াই সভা ভাঙিয়া দিলাম। খাওয়ার ব্যাপারটাকে আমি যে এত বড় করিয়া ধরিয়াছি এইজন্য কবি খুব খুশি হইলেন না। দোকান হইতে সামান্য কিছু খাবার আনাইয়া বহু সাধ্যসাধনায় কবিকে খাওয়ানো গেল।

সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করিবার সময় আমি কবির বাক্যের ভিতরে কয়েকটা প্রলাপ-উক্তির আভাস পাইয়াছিলাম। এক জায়গায় কবি বলিয়া ফেলিলেন, “আমি আল্লাকে দেখেছি। কিন্তু সে সব কথা বলবার সময় এখনও আসে নাই। সে সব বলবার অনুমতি যেদিন পাব, সেদিন আবার আপনাদের সামনে আসব।”

ইহার কিছুদিন পরেই শুনিলাম, কবি পাগল হইয়া গিয়াছেন। অসুস্থ অবস্থায় কবিকে দেখিবার জন্য বহুবার কবি-গৃহে গমন করিয়াছি। আগে তিনি আমাকে দেখিলে চিনিতে পারিতেন; আমার আব্বা কেমন আছেন, ছেলেরা কেমন আছে, জিজ্ঞাসা করিতেন। এখন আর চিনিতে পারেন না। কবির কোনো কবিতা আবৃত্তি করিলে কবি বড়ই খুশি হন। কিছু খাইতে দিলে খুশি হইয়া গ্রহণ করেন।

কবির শাশুড়ি খালা-আম্মার বিষয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর বিরূপ আলোচনা হইয়া থাকে। এই নিরপরাধা মহিলার বিষয়ে কিছু বলিয়া এ প্রসঙ্গের শেষ করিব।

একদিন বেলা একটার সময় কবি-গৃহে গমন করিয়া দেখি খালা-আম্মা বিষণ্ণ বদনে বসিয়া আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার মুখ আজ বেজার কেন?”

খালা-আম্মা বলিলেন, “জসীম। তোমরা জান, সব লোক আমার নিন্দা করে বেড়াচ্ছে।

মুরুর নামে যেখান থেকে যত টাকাপয়সা আসে আমি নাকি সব বাক্সে বন্ধ করে রাখি। নূরুকে ভালোমতো খাওয়াই না, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি না। তুমি জান, আমার ছেলে নেই। নুরুকেই আমি ছেলে করে নিয়েছি। আর আমিই বা কে। নুরুর দুটি ছেলে আছে-তারা বড় হয়ে উঠেছে। আমি যদি নূরুর টাকা লুকিয়ে রাখি, তারা তা সহ্য করবে কেন? তাদের বাপ খেতে পেলে কি না, তারা কি চোখে দেখে না। নিজের ছেলের চাইতে কি কবির প্রতি অপরের দরদ বেশি। আমি তোকে বলে দিলাম জসীম। এই সংসার থেকে একদিন আমি কোথাও চলে যাব। এই নিন্দা আর আমি সহ্য করতে পারিনে।”

 

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০৫)

১১:০০:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

নজরুল

আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরূপে দেখিয়া কবি কত সুখী হইলেন। তিনি আমার কানে কানে বলিলেন, “মায়েরা ছেলেদের প্রতি যে স্নেহ-মমতা ধারণ করে, তোমার চোখে-মুখে সমস্ত অবয়বে সেই স্নেহ-মমতার ছাপ দেখতে পেলাম।”

কবি আসিয়াই তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ ভাবে ছেলেদের সামনে কবিতা-গান আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। ক্লাস ছিল, ঘণ্টাখানেক থাকিয়া আমি চলিয়া গেলাম।

দুপুরবেলা ক্লাস করিতেছি-দেখিলাম, ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। মেয়েরা সবাই অনুপস্থিত। কারণ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, ফজলুল হক হলে নজরুল আসিয়াছেন। সবাই তাঁহার বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছে। বেলা তিনটার সময় ফজলুল হক হলে গিয়া দেখি, ছেলেমেয়েদের চাহিদা অনুসারে কবি গানের পর গান গাহিয়া চলিয়াছেন, কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিয়াছেন। কবির মুখ শুদ্ধ; সমস্ত অঙ্গ ক্লান্তিতে ভরা। খোঁজ লইয়া জানিলাম-সেই যে সকাল দশটায় কবি আসিয়াছেন, বারোটা পর্যন্ত মুসলিম হলে থাকিয়া তারপর ফজলুল হক হলে আগমন করিয়াছেন-ইহার মধ্যে কয়েক পেয়ালা চা আর পান ছাড়া কিছুই কবিকে খাইতে দেওয়া হয় নাই। আমার তখন কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই অবুঝ বয়স্ক-শিশুটিকে লইয়া ছেলেরা কি নিষ্ঠুর খেলাই না খেলিতেছে। কিন্তু তখন অবেলায় কোথাও কিছু খাবার পাইবার উপায় ছিল না। আমি এক রকম জোর করিয়াই সভা ভাঙিয়া দিলাম। খাওয়ার ব্যাপারটাকে আমি যে এত বড় করিয়া ধরিয়াছি এইজন্য কবি খুব খুশি হইলেন না। দোকান হইতে সামান্য কিছু খাবার আনাইয়া বহু সাধ্যসাধনায় কবিকে খাওয়ানো গেল।

সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করিবার সময় আমি কবির বাক্যের ভিতরে কয়েকটা প্রলাপ-উক্তির আভাস পাইয়াছিলাম। এক জায়গায় কবি বলিয়া ফেলিলেন, “আমি আল্লাকে দেখেছি। কিন্তু সে সব কথা বলবার সময় এখনও আসে নাই। সে সব বলবার অনুমতি যেদিন পাব, সেদিন আবার আপনাদের সামনে আসব।”

ইহার কিছুদিন পরেই শুনিলাম, কবি পাগল হইয়া গিয়াছেন। অসুস্থ অবস্থায় কবিকে দেখিবার জন্য বহুবার কবি-গৃহে গমন করিয়াছি। আগে তিনি আমাকে দেখিলে চিনিতে পারিতেন; আমার আব্বা কেমন আছেন, ছেলেরা কেমন আছে, জিজ্ঞাসা করিতেন। এখন আর চিনিতে পারেন না। কবির কোনো কবিতা আবৃত্তি করিলে কবি বড়ই খুশি হন। কিছু খাইতে দিলে খুশি হইয়া গ্রহণ করেন।

কবির শাশুড়ি খালা-আম্মার বিষয়ে আমাদের সমাজে প্রচুর বিরূপ আলোচনা হইয়া থাকে। এই নিরপরাধা মহিলার বিষয়ে কিছু বলিয়া এ প্রসঙ্গের শেষ করিব।

একদিন বেলা একটার সময় কবি-গৃহে গমন করিয়া দেখি খালা-আম্মা বিষণ্ণ বদনে বসিয়া আছেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার মুখ আজ বেজার কেন?”

খালা-আম্মা বলিলেন, “জসীম। তোমরা জান, সব লোক আমার নিন্দা করে বেড়াচ্ছে।

মুরুর নামে যেখান থেকে যত টাকাপয়সা আসে আমি নাকি সব বাক্সে বন্ধ করে রাখি। নূরুকে ভালোমতো খাওয়াই না, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি না। তুমি জান, আমার ছেলে নেই। নুরুকেই আমি ছেলে করে নিয়েছি। আর আমিই বা কে। নুরুর দুটি ছেলে আছে-তারা বড় হয়ে উঠেছে। আমি যদি নূরুর টাকা লুকিয়ে রাখি, তারা তা সহ্য করবে কেন? তাদের বাপ খেতে পেলে কি না, তারা কি চোখে দেখে না। নিজের ছেলের চাইতে কি কবির প্রতি অপরের দরদ বেশি। আমি তোকে বলে দিলাম জসীম। এই সংসার থেকে একদিন আমি কোথাও চলে যাব। এই নিন্দা আর আমি সহ্য করতে পারিনে।”

 

চলবে…..