১২:২৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
  • 61

নজরুল

এই বলিয়া খালা-আম্মা কাঁদিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, “খালা-আম্মা। কাঁদবেন না। একদিন সত্য উদঘাটিত হবেই।”

খালা-আম্মা আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গেলেন, যে ঘরে নজরুল থাকিতেন সেই ঘরে। দেখিলাম, পায়খানা করিয়া কাপড়-জামা সমস্ত অপরিষ্কার করিয়া কবি বসিয়া আছেন। খালাআম্মা বলিলেন, “আমি হিন্দু-বিধবা, এই সব পরিষ্কার করে স্নান করে তবে রান্না করতে বসব। খেতে খেতে বেলা পাঁচটা বাজবে। রোজ এই ভাবে তিন-চার বার পরিষ্কার করতে হয়। যারা নিন্দা করে তাদের বোলো, তারা এসে যেন এই কাজের ভার নেয়। তারপর যেখানে চক্ষু যায়, আমি চলে যাব।” তখন বুঝিতে পারি নাই, সত্য সত্যই খালা-আম্মা ইহা করিবেন।

ইহার কিছুদিন পরে খালা-আম্মা সেই যে কোথায় চলিয়া গেলেন কিছুতেই আর তাঁহার খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

দু-একজন কৃত্রিম নজরুল-ভক্তের মুখে আজও খালা-আম্মার নিন্দা শোনা যায়। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, “নজরুলের টাকা সমস্ত তাঁর শাশুড়ির পেটে।” বিনা অপরাধে এরূপ শাস্তি পাইতে আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। রক্ষণশীল হিন্দু-ঘরের এই বিধবা নিজের মেয়েটির হাত ধরিয়া একদিন এই প্রতিভাধর ছন্নছাড়া কবির সঙ্গে অকূলে ভাসিয়াছিলেন। নিজের সমাজের হাতে, আত্মীয়স্বজনের হাতে, সেদিন তাঁহার গঞ্জনার সীমা ছিল না। সেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে তিনি তৃণের মতো পদতলে দলিত করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী নিন্দা অন্য ধরনের। এই নিন্দা তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না।

খালা-আম্মা আজ বাঁচিয়া আছেন কিনা জানি না। ইহলোকে বা পরলোকে যেখানে থাকুন, তিনি যেন তাঁর এই পাতানো বোনপোটির একফোঁটা অশ্রুজলের সমবেদনা গ্রহণ করেন। মুহূর্তের জন্যও যেন একবার স্মরণ করেন, ভালো কাজ করিলে তাহা বৃথা যায় না। খালা-আম্মার সেই নীরব আত্মত্যাগ অন্তত পক্ষে একজনের অন্তরের বীণায় আজও মধুর সুরলহরি বিস্তার করিতেছে।

আমার ভাবি সাহেবার কথা আর কি বলিব। কত সীমাহীন দুঃখের সাগরেই না তিনি ভাসিয়া চলিয়াছেন। অর্ধাঙ্গ হইয়া তিনি বিছানা হইতে উঠিতে পারেন না। তবে মুখের সেই মধুর হাসিটি-যে হাসি সেই প্রথম বধূজীবনে তাঁহার মুখে দেখিয়াছিলাম, যে হাসিটি দিয়া ছন্নছাড়া কবিকে গৃহের লতা-শৃঙ্খলে বাঁধিয়াছিলেন, যে হাসিটির বিনিময়ে আকাশের চাঁদ হইতে, সন্ধ্যা-সকালের রঙিন মেঘ হইতে নুড়িপাথর কুড়াইয়া আপন বুকের স্নেহমমতায় শিশু কুসুমগুলি গড়িয়া কবির কোলে সাজাইয়া দিয়াছিলেন, আমরণ হয়তো তাঁহার মুখে

সেই হাসিটি লাগিয়াছিল।

রোগগ্রস্ত কবি অধিকাংশ সময় ভাবির শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পুরাতন পুস্তকের পাতা উলটান। হায় রে, কবির অতীত জীবননাট্যের বিস্মৃত পাতাগুলি আর কি কোনোদিন অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিবে?

চলবে…..

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২০৬)

১১:০০:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

নজরুল

এই বলিয়া খালা-আম্মা কাঁদিতে লাগিলেন। আমি বলিলাম, “খালা-আম্মা। কাঁদবেন না। একদিন সত্য উদঘাটিত হবেই।”

খালা-আম্মা আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া গেলেন, যে ঘরে নজরুল থাকিতেন সেই ঘরে। দেখিলাম, পায়খানা করিয়া কাপড়-জামা সমস্ত অপরিষ্কার করিয়া কবি বসিয়া আছেন। খালাআম্মা বলিলেন, “আমি হিন্দু-বিধবা, এই সব পরিষ্কার করে স্নান করে তবে রান্না করতে বসব। খেতে খেতে বেলা পাঁচটা বাজবে। রোজ এই ভাবে তিন-চার বার পরিষ্কার করতে হয়। যারা নিন্দা করে তাদের বোলো, তারা এসে যেন এই কাজের ভার নেয়। তারপর যেখানে চক্ষু যায়, আমি চলে যাব।” তখন বুঝিতে পারি নাই, সত্য সত্যই খালা-আম্মা ইহা করিবেন।

ইহার কিছুদিন পরে খালা-আম্মা সেই যে কোথায় চলিয়া গেলেন কিছুতেই আর তাঁহার খোঁজ পাওয়া যায় নাই।

দু-একজন কৃত্রিম নজরুল-ভক্তের মুখে আজও খালা-আম্মার নিন্দা শোনা যায়। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, “নজরুলের টাকা সমস্ত তাঁর শাশুড়ির পেটে।” বিনা অপরাধে এরূপ শাস্তি পাইতে আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। রক্ষণশীল হিন্দু-ঘরের এই বিধবা নিজের মেয়েটির হাত ধরিয়া একদিন এই প্রতিভাধর ছন্নছাড়া কবির সঙ্গে অকূলে ভাসিয়াছিলেন। নিজের সমাজের হাতে, আত্মীয়স্বজনের হাতে, সেদিন তাঁহার গঞ্জনার সীমা ছিল না। সেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে তিনি তৃণের মতো পদতলে দলিত করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী নিন্দা অন্য ধরনের। এই নিন্দা তিনি সহ্য করিতে পারিলেন না।

খালা-আম্মা আজ বাঁচিয়া আছেন কিনা জানি না। ইহলোকে বা পরলোকে যেখানে থাকুন, তিনি যেন তাঁর এই পাতানো বোনপোটির একফোঁটা অশ্রুজলের সমবেদনা গ্রহণ করেন। মুহূর্তের জন্যও যেন একবার স্মরণ করেন, ভালো কাজ করিলে তাহা বৃথা যায় না। খালা-আম্মার সেই নীরব আত্মত্যাগ অন্তত পক্ষে একজনের অন্তরের বীণায় আজও মধুর সুরলহরি বিস্তার করিতেছে।

আমার ভাবি সাহেবার কথা আর কি বলিব। কত সীমাহীন দুঃখের সাগরেই না তিনি ভাসিয়া চলিয়াছেন। অর্ধাঙ্গ হইয়া তিনি বিছানা হইতে উঠিতে পারেন না। তবে মুখের সেই মধুর হাসিটি-যে হাসি সেই প্রথম বধূজীবনে তাঁহার মুখে দেখিয়াছিলাম, যে হাসিটি দিয়া ছন্নছাড়া কবিকে গৃহের লতা-শৃঙ্খলে বাঁধিয়াছিলেন, যে হাসিটির বিনিময়ে আকাশের চাঁদ হইতে, সন্ধ্যা-সকালের রঙিন মেঘ হইতে নুড়িপাথর কুড়াইয়া আপন বুকের স্নেহমমতায় শিশু কুসুমগুলি গড়িয়া কবির কোলে সাজাইয়া দিয়াছিলেন, আমরণ হয়তো তাঁহার মুখে

সেই হাসিটি লাগিয়াছিল।

রোগগ্রস্ত কবি অধিকাংশ সময় ভাবির শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পুরাতন পুস্তকের পাতা উলটান। হায় রে, কবির অতীত জীবননাট্যের বিস্মৃত পাতাগুলি আর কি কোনোদিন অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিবে?

চলবে…..