০২:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

বুদাপেস্টের শেষ দিনগুলো

এক গৌরবময় শহরের পতন

এক সময় ইউরোপের প্রভাবশালী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বুদাপেস্ট। বার্লিন, প্যারিস ও ভিয়েনার মতো শহরগুলোর সঙ্গে তুলনীয় এই শহরটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর ছিল। এখানে বাস করতেন খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ বেলা বার্তোক ও ফ্রান্‌জ লিস্‌ট, লেখক আর্থার কোয়েস্টলার ও কার্ল পোলানই, চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল কার্টিজ (যিনি ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’ তৈরি করেন) ও আলেকজান্ডার কর্দা এবং পদার্থবিদ জন ভন নিউম্যান ও লিও সিজলার্ড।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বুদাপেস্ট ছিল ইউরোপের অন্যতম বড় ইহুদি সংস্কৃতি কেন্দ্র, যেখানে প্রায় ২ লাখ ইহুদি বাস করতেন— যা ছিল শহরের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা। দোহানী স্ট্রিটের বিখ্যাত সিনাগগ ছিল তৎকালীন ইউরোপের বৃহত্তম।

ধ্বংসের পথে বুদাপেস্ট

যুদ্ধ শুরুর আগেই শহরের অনেক প্রতিভাবান মানুষ বিদেশে পালিয়ে যান। পাঁচ বছরের মাথায় বুদাপেস্ট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, আর সেই আগের জৌলুস আর কখনও ফিরে পায়নি। ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যাডাম লেবর তার নতুন বই The Last Days of Budapest-এ এই রূপান্তরের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

লেবরের অনুসন্ধানভিত্তিক লেখায় উঠে এসেছে কীভাবে যুদ্ধকালে বুদাপেস্ট পরিণত হয়েছিল গুপ্তচরবৃত্তি ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে। তিনি নানা উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে আছে ঝুঁকিপূর্ণ কূটনৈতিক মিশন, পোলিশ উদ্বাস্তু, আমেরিকান কূটনীতিক, জায়োনিস্ট এজেন্ট এবং হাঙ্গেরির নামকরা অভিনেত্রী ও নাৎসিবিরোধী কর্মী কাতালিন কারাডি।

হোর্থি শাসনের দ্বিচারিতা ও পতন

তৎকালীন শাসক অ্যাডমিরাল মিকলোস হোর্থি হিটলারের নাৎসি জার্মানির সঙ্গে হাত মেলান ১৯৪০ সালের শেষে, আশায় ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারা অঞ্চলগুলো ফিরিয়ে আনবেন। নাৎসিদের খুশি রাখতে তিনি ধীরে ধীরে হাঙ্গেরির ইহুদিদের অধিকার হরণ করতে থাকেন। তবে একই সঙ্গে তিনি গোপনে ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন।

এই স্বাধীনচেতা মনোভাব নাৎসিদের রোষানলে ফেলে হোর্থিকে। ১৯৪৪ সালের মার্চে নাৎসিরা হাঙ্গেরি দখল করে এবং তখন থেকেই ইহুদিদের নিপীড়ন শুরু হয় ঘন ঘন হারে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ গ্রামীণ ইহুদিকে ধরে পাঠানো হয় অশউইৎজ-বিরকেনাউ মৃত্যু শিবিরে। বুদাপেস্টের ইহুদিদের ঠেলে দেওয়া হয় গেটোর ভেতর।

তাণ্ডবের নাম অ্যারো ক্রস

হোর্থির পতনের পর ক্ষমতায় আসে নাৎসিপন্থী ফেরেন্স সালাসি। এরপর শুরু হয় আরও রক্তাক্ত অধ্যায়। হাঙ্গেরির চরম ডানপন্থী, বিদ্বেষমূলক গোষ্ঠী অ্যারো ক্রস প্রকাশ্য হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা ইহুদিদের গুলি করে দানিউব নদীতে ফেলে দিত, একসঙ্গে তিনজনকে বেঁধে মাঝের জনকে গুলি করে বাকিদের নদীতে টেনে নিয়ে যেত। এভাবে প্রায় ২০ হাজার ইহুদি নিহত হন।

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ান সেনারা বুদাপেস্টে প্রবেশ করলে রক্তপাত আরও বেড়ে যায়। শহরের পুরাতন অংশগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। রাশিয়ার প্রায় ৮০ হাজার সেনা নিহত হন, আর বিজয়ের পর তারা অনুগ্রহ দেখাতে নারাজ ছিলেন।

ইতিহাসের তীক্ষ্ণ বিচারে হোর্থির ভূমিকা

লেবরের ভাষ্য অনুযায়ী, হোর্থি প্রশাসন, পুলিশ এবং অন্যান্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যদি চাইত, অনেক মৃত্যুই প্রতিরোধ করা যেত। বরং তারা অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। একজন হাঙ্গেরিয়ান ইতিহাসবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “নাজি-অধিকৃত ইউরোপের আর কোথাও এত বড় পরিসরে প্রকাশ্যে এত দীর্ঘ সময় ধরে ইহুদি হত্যা হয়নি।”

সোভিয়েত দখলের পরও অনেক অ্যারো ক্রস সদস্য তাদের সন্ত্রাসী আচরণ চালিয়ে যায়— এবার সোভিয়েত গোয়েন্দা পুলিশের ছত্রছায়ায়।

অতীতের শিক্ষাবর্তমানের ইঙ্গিত

লেবরের বই শুধু গবেষণাধর্মী বলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি সময়োপযোগী একটি সতর্কবার্তাও বটে। এটি মনে করিয়ে দেয়, কত দ্রুত একটি প্রগতিশীল ও উদার সমাজ হিংস্রতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হতে পারে। একবার শিকড় গেড়ে বসলে কর্তৃত্ববাদকে সরিয়ে দেওয়া কতটা কঠিন— আজকের হাঙ্গেরির শাসক ভিক্টর অরবানের দিকে তাকালেই সেটি স্পষ্ট বোঝা যায়।

বুদাপেস্টের শেষ দিনগুলো

১০:০০:১৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

এক গৌরবময় শহরের পতন

এক সময় ইউরোপের প্রভাবশালী শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বুদাপেস্ট। বার্লিন, প্যারিস ও ভিয়েনার মতো শহরগুলোর সঙ্গে তুলনীয় এই শহরটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ভরপুর ছিল। এখানে বাস করতেন খ্যাতিমান সঙ্গীতজ্ঞ বেলা বার্তোক ও ফ্রান্‌জ লিস্‌ট, লেখক আর্থার কোয়েস্টলার ও কার্ল পোলানই, চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল কার্টিজ (যিনি ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’ তৈরি করেন) ও আলেকজান্ডার কর্দা এবং পদার্থবিদ জন ভন নিউম্যান ও লিও সিজলার্ড।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বুদাপেস্ট ছিল ইউরোপের অন্যতম বড় ইহুদি সংস্কৃতি কেন্দ্র, যেখানে প্রায় ২ লাখ ইহুদি বাস করতেন— যা ছিল শহরের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা। দোহানী স্ট্রিটের বিখ্যাত সিনাগগ ছিল তৎকালীন ইউরোপের বৃহত্তম।

ধ্বংসের পথে বুদাপেস্ট

যুদ্ধ শুরুর আগেই শহরের অনেক প্রতিভাবান মানুষ বিদেশে পালিয়ে যান। পাঁচ বছরের মাথায় বুদাপেস্ট ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়, আর সেই আগের জৌলুস আর কখনও ফিরে পায়নি। ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যাডাম লেবর তার নতুন বই The Last Days of Budapest-এ এই রূপান্তরের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

লেবরের অনুসন্ধানভিত্তিক লেখায় উঠে এসেছে কীভাবে যুদ্ধকালে বুদাপেস্ট পরিণত হয়েছিল গুপ্তচরবৃত্তি ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে। তিনি নানা উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে আছে ঝুঁকিপূর্ণ কূটনৈতিক মিশন, পোলিশ উদ্বাস্তু, আমেরিকান কূটনীতিক, জায়োনিস্ট এজেন্ট এবং হাঙ্গেরির নামকরা অভিনেত্রী ও নাৎসিবিরোধী কর্মী কাতালিন কারাডি।

হোর্থি শাসনের দ্বিচারিতা ও পতন

তৎকালীন শাসক অ্যাডমিরাল মিকলোস হোর্থি হিটলারের নাৎসি জার্মানির সঙ্গে হাত মেলান ১৯৪০ সালের শেষে, আশায় ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হারা অঞ্চলগুলো ফিরিয়ে আনবেন। নাৎসিদের খুশি রাখতে তিনি ধীরে ধীরে হাঙ্গেরির ইহুদিদের অধিকার হরণ করতে থাকেন। তবে একই সঙ্গে তিনি গোপনে ব্রিটিশ ও আমেরিকানদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন।

এই স্বাধীনচেতা মনোভাব নাৎসিদের রোষানলে ফেলে হোর্থিকে। ১৯৪৪ সালের মার্চে নাৎসিরা হাঙ্গেরি দখল করে এবং তখন থেকেই ইহুদিদের নিপীড়ন শুরু হয় ঘন ঘন হারে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় ৪ লাখ গ্রামীণ ইহুদিকে ধরে পাঠানো হয় অশউইৎজ-বিরকেনাউ মৃত্যু শিবিরে। বুদাপেস্টের ইহুদিদের ঠেলে দেওয়া হয় গেটোর ভেতর।

তাণ্ডবের নাম অ্যারো ক্রস

হোর্থির পতনের পর ক্ষমতায় আসে নাৎসিপন্থী ফেরেন্স সালাসি। এরপর শুরু হয় আরও রক্তাক্ত অধ্যায়। হাঙ্গেরির চরম ডানপন্থী, বিদ্বেষমূলক গোষ্ঠী অ্যারো ক্রস প্রকাশ্য হত্যাযজ্ঞ চালায়। তারা ইহুদিদের গুলি করে দানিউব নদীতে ফেলে দিত, একসঙ্গে তিনজনকে বেঁধে মাঝের জনকে গুলি করে বাকিদের নদীতে টেনে নিয়ে যেত। এভাবে প্রায় ২০ হাজার ইহুদি নিহত হন।

১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ান সেনারা বুদাপেস্টে প্রবেশ করলে রক্তপাত আরও বেড়ে যায়। শহরের পুরাতন অংশগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। রাশিয়ার প্রায় ৮০ হাজার সেনা নিহত হন, আর বিজয়ের পর তারা অনুগ্রহ দেখাতে নারাজ ছিলেন।

ইতিহাসের তীক্ষ্ণ বিচারে হোর্থির ভূমিকা

লেবরের ভাষ্য অনুযায়ী, হোর্থি প্রশাসন, পুলিশ এবং অন্যান্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যদি চাইত, অনেক মৃত্যুই প্রতিরোধ করা যেত। বরং তারা অনেক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। একজন হাঙ্গেরিয়ান ইতিহাসবিদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, “নাজি-অধিকৃত ইউরোপের আর কোথাও এত বড় পরিসরে প্রকাশ্যে এত দীর্ঘ সময় ধরে ইহুদি হত্যা হয়নি।”

সোভিয়েত দখলের পরও অনেক অ্যারো ক্রস সদস্য তাদের সন্ত্রাসী আচরণ চালিয়ে যায়— এবার সোভিয়েত গোয়েন্দা পুলিশের ছত্রছায়ায়।

অতীতের শিক্ষাবর্তমানের ইঙ্গিত

লেবরের বই শুধু গবেষণাধর্মী বলেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি সময়োপযোগী একটি সতর্কবার্তাও বটে। এটি মনে করিয়ে দেয়, কত দ্রুত একটি প্রগতিশীল ও উদার সমাজ হিংস্রতা ও স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হতে পারে। একবার শিকড় গেড়ে বসলে কর্তৃত্ববাদকে সরিয়ে দেওয়া কতটা কঠিন— আজকের হাঙ্গেরির শাসক ভিক্টর অরবানের দিকে তাকালেই সেটি স্পষ্ট বোঝা যায়।