সপ্তম পরিচ্ছেদ
শুনে বাবা হাসতে শুরু করে দিলেন। আর আমাকে কী যেন বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। উনি কী যে আমায় বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, সেদিন তা বুঝতে পারি নি। কারণ, বাবার মতে, সাইবেরিয়ার কয়েদীরা মোটেই নাকি কয়েদী ছিল না, কয়েদীদের মধ্যে বাবার পরিচিতও ছিল অনেকে, আর তাছাড়া সাইবেরিয়ায় নাকি অনেক ভালো লোক ছিল, অন্ততপক্ষে আর জামাসে যত ভালো লোক ছিল সাইবেরিয়ায় তার চেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল তারা।
এই সব কথা সেদিন আমার কানে ঢুকলেও মনের মধ্যে ধরা পড়ে নি। এ-রকম আরও কত-যে কথা শুনেছিলুম সেদিন! আর মাত্র এখনই সেই সব কথার মানে একটু-একটু বুঝতে শুরু করেছিলুম।
‘না। আমার সেই অতীত জীবনে কখনই ঘুণাক্ষরে আমি সন্দেহ করি নি, কিংবা ভাবতেও পারি নি যে আমার বাবা ছিলেন বিপ্লবী। আর এখন যে আমি লাল ফৌজের সঙ্গে আছি আর কাঁধে রাইফেল বয়ে বেড়াচ্ছি, এর কারণ এই নয় যে আমার বাবা বিপ্লবী ছিলেন আর আমি তাঁর ছেলে। এ-ব্যাপারটা আপনা-আপনিই ঘটেছে। নিজে থেকেই আমি এ-পথ বেছে নিয়েছি,’ আমি ভাবলুম। আর এটা চিন্তা করে নিজের সম্বন্ধে আমার গর্ব বোধ হল। না, সত্যি কথা, এত তো পার্টি ছিল দেশে, অথচ আমি সঠিক পার্টিকেই, একমাত্র বিপ্লবী পার্টিকেই, ঠিক ঠিক বেছে নিতে পেরেছি!
চুবুককে আমার এই চিন্তার ভাগ দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলুম। আর হঠাৎ আমার কেমন মনে হল, কই, ঘোড়ার সামনে কেউ তো নেই। তাহলে কি এতক্ষণ ধরে এই অপরিচিত রাস্তায় ঘোড়াটা নিজের খুশিমতো গাড়ি টেনে নিয়ে চলেছে! ভয় পেয়ে হাঁক পাড়লুম, ‘চুবুক!’
‘উহ!’ ওঁর রুঢ়, সংক্ষিপ্ত উত্তর পাওয়া গেল। ‘চ্যাঁচাচ্চ কিসের জন্যি, শুনি?’ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বললুম, ‘এখনও কি অনেক দেরি, চুবুক?’
‘আচে খানিকটে দূর,’ উনি বললেন। তারপর থামলেন। ‘ইদিকে এস দিকি একবার। কোটটারে খুলি ফ্যালো। পাইপটা ধরাব আমি।’
ঘোড়ার মাথা-বরাবর অন্ধকারে পাইপটা ভেসে চলল জোনাকির মতো। আস্তে-আন্তে রাস্তাটা সমতল হয়ে গেল। দু-ধারের জঙ্গল খানিকটা সরে গেল রাস্তা থেকে। আমরা দু-জন হাঁটতে লাগলুম পাশাপাশি।