০২:৫৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ইট-কাঠের শহরে সবুজের এক নতুন ধরনের বিপ্লব

গাছ আর পাখির ঘর, আবার মানুষেরও—এই ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ‘গগনচুম্বী বন’ আজ থেকে ঠিক এক দশক আগে মিলানে যাত্রা শুরু করে। ইতালিয়ান স্থপতি স্টেফানো বয়েরি যখন ২০০৭-এ দুবাইয়ের মরুভূমিতে কাঁচ, সিরামিক ও ধাতুতে মোড়া শক্তি অপচয়ী আকাশচুম্বী নগরী তৈরি হতে দেখছিলেন, তখন তার মনে হয়েছিল: “এই গরম কাঁচের সৌধগুলোর বদলে সবুজ পাতায় ঢাকা উঁচু টাওয়ার কেমন হবে?” উত্তর মিলানের এক অবহেলিত শিল্পাঞ্চলের জন্য তিনি তখনই পরিকল্পনা শুরু করেন—কাঁচের বদলে পাতা, ইস্পাতের বদলে প্রাণ; প্রকৃতিকে স্থাপত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তুলবেন। সেই ভাবনাই রূপ নেয় বিশ্বের প্রথম ‘ভার্টিক্যাল ফরেস্ট’—বসকো ভের্তিকালে।

দশ বছর পূর্তি: বসকো ভের্তিকালে

Boeri Studio/ Dimitar Harizanov Milan's Bosco Verticale – completed 10 years ago – was the world's first vertical forest (Credit: Boeri Studio/ Dimitar Harizanov)

আজ বসকো ভের্তিকালের বয়স দশ। ‘ফ্লাইং গার্ডেনার’ নামে পরিচিত দড়িতে ঝোলা উদ্যানকর্মীরা টাওয়ারদুটির গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণ করেন। পাতার জলীয় বাষ্প ও ছায়া আবাসিকদের তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম রাখে। এই মাইলফলক উদ্‌যাপন করতে স্থাপত্য সংস্থা স্টেফানো বয়েরি আর্কিতেত্তি প্রকাশ করেছে Bosco Verticale: Morphology of a Vertical Forest শিরোনামের বই, যেখানে প্রকৃতি ও স্থাপত্যের ছেদবিন্দুতে কাজ করা চিন্তাবিদদের প্রবন্ধ ও ইওয়ান বান-এর তোলা ছবির সঙ্গে প্রকল্পের বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশক রিৎসোলির ভাষায়, “এটি এমন এক স্থাপত্যকর্মকে উদ্‌যাপন করে, যা পরিবেশ ও উদ্ভিজ্জ জগতের প্রতি সমবেদনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”

বইটি প্রচলিত স্থাপত্যের ধারাকে উল্টে বলেছে, “এটি গাছ আর পাখির বাড়ি; মানুষও সেখানে বাস করে।” ব্রিটিশ প্রাণতত্ত্ববিদ কলিন টাজের The Secret Life of Trees-এর মত বই থেকে শুরু করে ডেম জেন গুডলের মত প্রকৃতিবিদদের কথাও এতে উদ্ধৃত হয়েছে। জনসংখ্যা বাড়লেও, গুডলের মতে, “নগর পরিকল্পনায় প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”

Stefano Boeri Architetti Nanjing Vertical Forest in China follows the principles of Bosco Verticale (Credit: Stefano Boeri Architetti)

সবুজের ঢেউ শহরে ফিরছে

বসকো ভের্তিকালের পর থেকে দুবাই থেকে ডেনভার, অ্যান্টওয়ার্প থেকে আরলিংটন—শহরে শহরে গাছপালায় মোড়া নতুন ভবন গড়ে উঠছে। কায়রোতে আফ্রিকার প্রথম ভার্টিক্যাল ফরেস্ট এ বছর কাজ শুরু করতে চলেছে।

ধারণাটির ‘খরচবহুল’ তকমা দূর করতে নেদারল্যান্ডসের আইনডহোভেনে ২০২১-এ চালু হয় ট্রুডো ভার্টিক্যাল ফরেস্ট, যেখানে সামাজিক বাসভাড়া মাসিক ৬০০ ইউরোর মধ্যে সীমিত।

সংযুক্তির অনুভূতি

BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures The 21-storey-high Tao Zhu Yin Yuan in Taipei, Taiwan, was completed in 2024 (Credit: BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures)

ফ্রান্সের মন্টপেলিয়েতে দ্য সিক্রেট গার্ডেনস প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশ ফ্ল্যাট থাকবে স্বল্পভাড়ায়, ছাদ-কৃষি ও বৃষ্টির জল পুনর্ব্যবহারসহ নানা সবুজ উদ্যোগে সমৃদ্ধ। স্থপতি ভাঁসাঁ কাবোর ভাষায়, “এই ভবন দেখাচ্ছে—পরিবেশবাদ বাধা নয়; এটা জীবনদর্শন।” ফিলিপাইনের সেবুতে তাঁর নকশা করা দ্য রেইনবো ট্রি-র ৩০০ অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদেরই রঙিন গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে; ছাদে শেয়ার্ড গ্রীনহাউস ও নগর-মৌচাখানার মাধ্যমে গড়ে উঠবে সামাজিক বন্ধন।

গবেষণা যা বলছে

নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিনখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অফিসে গাছপালা থাকলে কর্মপরিবেশ আকর্ষণীয় হওয়ার পাশাপাশি কর্মীর সন্তুষ্টি বাড়ে, বায়ুগুণোন্নতির ফলেও স্বাস্থ্য সমস্যা কমে।

BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures Tao Zhu Yin Yuan features rotating balconies that optimise sunlight (Credit: BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures)

ওয়েলসের ১০ বছরের আরেকটি বিশ্লেষণে ২৩ লক্ষ স্বাস্থ্য নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়—সবচেয়ে সবুজ পরিবেশে থাকা মানুষদের উদ্বেগ ও হতাশা ৪০% কম, নিম্নআয়ের এলাকায় সবুজ ও জলাশয়ে প্রবেশাধিকার থাকলে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি আরও ১০% হ্রাস পায়।

চিকিৎসা-সেবায় জীবপ্রিয় নকশা

বেলজিয়ামের লা লুভিয়েরে-এ কাবোর হসপিউড ২১ ভবনে উল্লম্ব বন রোগীর স্ট্রেস কমিয়ে পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করবে বলে আশা। ইতালিতে বয়েরির নকশা করা মিলান নিউ পলিক্লিনিকো হাসপাতালের ছাদে থাকবে ৭,০০০ বর্গমিটারের বাগান। বয়েরি বলেন, “এটি শুধু দীর্ঘমেয়াদি সেবাকেন্দ্র নয়; প্রকৃতির সান্নিধ্যে স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন ও পারস্পরিক যোগাযোগের নতুন পরিভাষা।”

বিনোদন ও ব্যবসাও সবুজের ছায়ায়

সিঙ্গাপুরের ১০-তলা বিশিষ্ট জুয়েল চাঙ্গি এয়ারপোর্ট-এ ১,৪০০ গাছ ও ৪০-মিটার উঁচু বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইনডোর জলপ্রপাত ২০১৯ থেকে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছে। আমস্টারডামের হোটেল জাকার্তা-র বাঁশের সুসজ্জিত অভ্যন্তরে বৃষ্টির জলে সিক্ত ক্রমবর্ধমান এক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন মধ্য আঙিনায় ছাদ ছুঁতে চলেছে। রটারডামের দ্য ডিপো-র ৪০-মিটার উঁচু ছাদের বন আর্ট সংগ্রহশালার ওপর স্থাপন করে বন্যা ঝুঁকি কমিয়েছে।

Boeri Studio/ Giovanni Nardi The multi-award-winning Bosco Verticale keeps its inhabitants cool, and provides a home for birds as well as humans (Credit: Boeri Studio/ Giovanni Nardi)

জলবায়ু মোকাবিলায় উঁচু বন

তাইপেইয়ের ২১-তলা তাও ঝু ইয়িন ইয়ুয়ান ডিএনএ-র ডাবল হেলিক্স আকৃতির; ২৩,০০০ গাছ-গাছালি বছরে প্রায় ১৩০ টন CO₂ শোষণ করে। এগুলোর শীতল ছায়ায় এয়ার-কন্ডিশনিংয়ের প্রয়োজন ৩০% কমে যায়। ভবনের ঘূর্ণায়মান বারান্দা সূর্যালোকের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে; কেন্দ্রীয় ভেন্টিলেশন চিমনি যেন ফুসফুস, নিচ থেকে বাতাস টেনে শোধন করে ওপরে ছাড়ে।

মাটির দখল কমনগরে ফিরুক প্রাণ

উঁচু বন আয়তনে সরু বলে মাটির ওপর সিলিং কমিয়ে ভূমি প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দেয়, পানি ধরে রেখে বন্যা প্রতিরোধ করে। কাবোর মতে, “আমার প্রকল্পগুলোয় শহর জলবায়ু সমস্যার নয়, সমাধানের অংশ।” ভবনগুলো বাসযোগ্য বৃক্ষের মতো—CO₂ শোষণ, জ্বালানি উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়। মানসিক স্বাস্থ্যখাত ও উষ্ণায়ন—দুই সঙ্কটেরই সমাধানের ইঙ্গিত বহন করে জীবপ্রিয় স্থাপত্য। তাই চীনের গুইঝৌ প্রদেশের দূষণকবলিত লিয়ুঝোয় বয়েরির ফরেস্ট সিটি-র (৩০,০০০ বাসিন্দার জন্য স্ব-নির্ভর শক্তি) অনুমোদন হয়েছে; মেক্সিকোর কানকুন স্মার্ট ফরেস্ট সিটিও নির্মাণের অপেক্ষায়, যেখানে জ্বালানিচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ থাকবে।

ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি হিসেবে প্রকৃতি

মিলানের সেই সূচনা করা টাওয়ারজোড়া আজও ছাদে সৌর প্যানেল বসিয়ে রোদ ধরছে, ভূগর্ভস্থ জল তুলছে—একেবারে গাছের মতো। দার্শনিক এমানুয়েল কচিয়া লিখেছেন, “প্রকৃতি কোনো অতীত নয়; এটাই আমাদের প্রযুক্তিগত ভবিষ্যৎ।” আর বয়েরির চোখে, তাঁর সৃষ্টি কেবল ভবন নয়, “একটি রাজনৈতিক ইশতেহার”—স্বাভাবিক ও স্পষ্ট বার্তা: “মানুষের জন্য নির্মিত স্থানে জীবিত প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে—না বেশি, না কম।”

ইট-কাঠের শহরে সবুজের এক নতুন ধরনের বিপ্লব

০৫:৩৪:৪৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ জুন ২০২৫

গাছ আর পাখির ঘর, আবার মানুষেরও—এই ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ‘গগনচুম্বী বন’ আজ থেকে ঠিক এক দশক আগে মিলানে যাত্রা শুরু করে। ইতালিয়ান স্থপতি স্টেফানো বয়েরি যখন ২০০৭-এ দুবাইয়ের মরুভূমিতে কাঁচ, সিরামিক ও ধাতুতে মোড়া শক্তি অপচয়ী আকাশচুম্বী নগরী তৈরি হতে দেখছিলেন, তখন তার মনে হয়েছিল: “এই গরম কাঁচের সৌধগুলোর বদলে সবুজ পাতায় ঢাকা উঁচু টাওয়ার কেমন হবে?” উত্তর মিলানের এক অবহেলিত শিল্পাঞ্চলের জন্য তিনি তখনই পরিকল্পনা শুরু করেন—কাঁচের বদলে পাতা, ইস্পাতের বদলে প্রাণ; প্রকৃতিকে স্থাপত্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তুলবেন। সেই ভাবনাই রূপ নেয় বিশ্বের প্রথম ‘ভার্টিক্যাল ফরেস্ট’—বসকো ভের্তিকালে।

দশ বছর পূর্তি: বসকো ভের্তিকালে

Boeri Studio/ Dimitar Harizanov Milan's Bosco Verticale – completed 10 years ago – was the world's first vertical forest (Credit: Boeri Studio/ Dimitar Harizanov)

আজ বসকো ভের্তিকালের বয়স দশ। ‘ফ্লাইং গার্ডেনার’ নামে পরিচিত দড়িতে ঝোলা উদ্যানকর্মীরা টাওয়ারদুটির গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণ করেন। পাতার জলীয় বাষ্প ও ছায়া আবাসিকদের তাপমাত্রা বাইরের তুলনায় প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম রাখে। এই মাইলফলক উদ্‌যাপন করতে স্থাপত্য সংস্থা স্টেফানো বয়েরি আর্কিতেত্তি প্রকাশ করেছে Bosco Verticale: Morphology of a Vertical Forest শিরোনামের বই, যেখানে প্রকৃতি ও স্থাপত্যের ছেদবিন্দুতে কাজ করা চিন্তাবিদদের প্রবন্ধ ও ইওয়ান বান-এর তোলা ছবির সঙ্গে প্রকল্পের বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে। প্রকাশক রিৎসোলির ভাষায়, “এটি এমন এক স্থাপত্যকর্মকে উদ্‌যাপন করে, যা পরিবেশ ও উদ্ভিজ্জ জগতের প্রতি সমবেদনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।”

বইটি প্রচলিত স্থাপত্যের ধারাকে উল্টে বলেছে, “এটি গাছ আর পাখির বাড়ি; মানুষও সেখানে বাস করে।” ব্রিটিশ প্রাণতত্ত্ববিদ কলিন টাজের The Secret Life of Trees-এর মত বই থেকে শুরু করে ডেম জেন গুডলের মত প্রকৃতিবিদদের কথাও এতে উদ্ধৃত হয়েছে। জনসংখ্যা বাড়লেও, গুডলের মতে, “নগর পরিকল্পনায় প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”

Stefano Boeri Architetti Nanjing Vertical Forest in China follows the principles of Bosco Verticale (Credit: Stefano Boeri Architetti)

সবুজের ঢেউ শহরে ফিরছে

বসকো ভের্তিকালের পর থেকে দুবাই থেকে ডেনভার, অ্যান্টওয়ার্প থেকে আরলিংটন—শহরে শহরে গাছপালায় মোড়া নতুন ভবন গড়ে উঠছে। কায়রোতে আফ্রিকার প্রথম ভার্টিক্যাল ফরেস্ট এ বছর কাজ শুরু করতে চলেছে।

ধারণাটির ‘খরচবহুল’ তকমা দূর করতে নেদারল্যান্ডসের আইনডহোভেনে ২০২১-এ চালু হয় ট্রুডো ভার্টিক্যাল ফরেস্ট, যেখানে সামাজিক বাসভাড়া মাসিক ৬০০ ইউরোর মধ্যে সীমিত।

সংযুক্তির অনুভূতি

BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures The 21-storey-high Tao Zhu Yin Yuan in Taipei, Taiwan, was completed in 2024 (Credit: BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures)

ফ্রান্সের মন্টপেলিয়েতে দ্য সিক্রেট গার্ডেনস প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশ ফ্ল্যাট থাকবে স্বল্পভাড়ায়, ছাদ-কৃষি ও বৃষ্টির জল পুনর্ব্যবহারসহ নানা সবুজ উদ্যোগে সমৃদ্ধ। স্থপতি ভাঁসাঁ কাবোর ভাষায়, “এই ভবন দেখাচ্ছে—পরিবেশবাদ বাধা নয়; এটা জীবনদর্শন।” ফিলিপাইনের সেবুতে তাঁর নকশা করা দ্য রেইনবো ট্রি-র ৩০০ অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দাদেরই রঙিন গাছপালা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে; ছাদে শেয়ার্ড গ্রীনহাউস ও নগর-মৌচাখানার মাধ্যমে গড়ে উঠবে সামাজিক বন্ধন।

গবেষণা যা বলছে

নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিনখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অফিসে গাছপালা থাকলে কর্মপরিবেশ আকর্ষণীয় হওয়ার পাশাপাশি কর্মীর সন্তুষ্টি বাড়ে, বায়ুগুণোন্নতির ফলেও স্বাস্থ্য সমস্যা কমে।

BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures Tao Zhu Yin Yuan features rotating balconies that optimise sunlight (Credit: BES Engineering - Vincent Callebaut Architectures)

ওয়েলসের ১০ বছরের আরেকটি বিশ্লেষণে ২৩ লক্ষ স্বাস্থ্য নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়—সবচেয়ে সবুজ পরিবেশে থাকা মানুষদের উদ্বেগ ও হতাশা ৪০% কম, নিম্নআয়ের এলাকায় সবুজ ও জলাশয়ে প্রবেশাধিকার থাকলে মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকি আরও ১০% হ্রাস পায়।

চিকিৎসা-সেবায় জীবপ্রিয় নকশা

বেলজিয়ামের লা লুভিয়েরে-এ কাবোর হসপিউড ২১ ভবনে উল্লম্ব বন রোগীর স্ট্রেস কমিয়ে পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করবে বলে আশা। ইতালিতে বয়েরির নকশা করা মিলান নিউ পলিক্লিনিকো হাসপাতালের ছাদে থাকবে ৭,০০০ বর্গমিটারের বাগান। বয়েরি বলেন, “এটি শুধু দীর্ঘমেয়াদি সেবাকেন্দ্র নয়; প্রকৃতির সান্নিধ্যে স্বাস্থ্য, পুনর্বাসন ও পারস্পরিক যোগাযোগের নতুন পরিভাষা।”

বিনোদন ও ব্যবসাও সবুজের ছায়ায়

সিঙ্গাপুরের ১০-তলা বিশিষ্ট জুয়েল চাঙ্গি এয়ারপোর্ট-এ ১,৪০০ গাছ ও ৪০-মিটার উঁচু বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ইনডোর জলপ্রপাত ২০১৯ থেকে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছে। আমস্টারডামের হোটেল জাকার্তা-র বাঁশের সুসজ্জিত অভ্যন্তরে বৃষ্টির জলে সিক্ত ক্রমবর্ধমান এক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন মধ্য আঙিনায় ছাদ ছুঁতে চলেছে। রটারডামের দ্য ডিপো-র ৪০-মিটার উঁচু ছাদের বন আর্ট সংগ্রহশালার ওপর স্থাপন করে বন্যা ঝুঁকি কমিয়েছে।

Boeri Studio/ Giovanni Nardi The multi-award-winning Bosco Verticale keeps its inhabitants cool, and provides a home for birds as well as humans (Credit: Boeri Studio/ Giovanni Nardi)

জলবায়ু মোকাবিলায় উঁচু বন

তাইপেইয়ের ২১-তলা তাও ঝু ইয়িন ইয়ুয়ান ডিএনএ-র ডাবল হেলিক্স আকৃতির; ২৩,০০০ গাছ-গাছালি বছরে প্রায় ১৩০ টন CO₂ শোষণ করে। এগুলোর শীতল ছায়ায় এয়ার-কন্ডিশনিংয়ের প্রয়োজন ৩০% কমে যায়। ভবনের ঘূর্ণায়মান বারান্দা সূর্যালোকের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে; কেন্দ্রীয় ভেন্টিলেশন চিমনি যেন ফুসফুস, নিচ থেকে বাতাস টেনে শোধন করে ওপরে ছাড়ে।

মাটির দখল কমনগরে ফিরুক প্রাণ

উঁচু বন আয়তনে সরু বলে মাটির ওপর সিলিং কমিয়ে ভূমি প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দেয়, পানি ধরে রেখে বন্যা প্রতিরোধ করে। কাবোর মতে, “আমার প্রকল্পগুলোয় শহর জলবায়ু সমস্যার নয়, সমাধানের অংশ।” ভবনগুলো বাসযোগ্য বৃক্ষের মতো—CO₂ শোষণ, জ্বালানি উৎপাদন ও জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়। মানসিক স্বাস্থ্যখাত ও উষ্ণায়ন—দুই সঙ্কটেরই সমাধানের ইঙ্গিত বহন করে জীবপ্রিয় স্থাপত্য। তাই চীনের গুইঝৌ প্রদেশের দূষণকবলিত লিয়ুঝোয় বয়েরির ফরেস্ট সিটি-র (৩০,০০০ বাসিন্দার জন্য স্ব-নির্ভর শক্তি) অনুমোদন হয়েছে; মেক্সিকোর কানকুন স্মার্ট ফরেস্ট সিটিও নির্মাণের অপেক্ষায়, যেখানে জ্বালানিচালিত গাড়ি নিষিদ্ধ থাকবে।

ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি হিসেবে প্রকৃতি

মিলানের সেই সূচনা করা টাওয়ারজোড়া আজও ছাদে সৌর প্যানেল বসিয়ে রোদ ধরছে, ভূগর্ভস্থ জল তুলছে—একেবারে গাছের মতো। দার্শনিক এমানুয়েল কচিয়া লিখেছেন, “প্রকৃতি কোনো অতীত নয়; এটাই আমাদের প্রযুক্তিগত ভবিষ্যৎ।” আর বয়েরির চোখে, তাঁর সৃষ্টি কেবল ভবন নয়, “একটি রাজনৈতিক ইশতেহার”—স্বাভাবিক ও স্পষ্ট বার্তা: “মানুষের জন্য নির্মিত স্থানে জীবিত প্রকৃতিকে ফিরিয়ে আনতে হবে—না বেশি, না কম।”