১০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

এইচএসসি থেকে ঝরে পড়ছে লাখো শিক্ষার্থী: দারিদ্র্যের অদৃশ্য গ্রাসে দেশের ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ এক নীরব সংকট। এই বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না সাড়ে ৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। অর্থনৈতিক চাপে বিপর্যস্ত অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষা চালিয়ে নিতে পারছেন না। ফলে শিক্ষাজীবন থেমে যাচ্ছে মাঝপথে। বিশেষজ্ঞরা একে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের জন্য বড় ধরনের “নিরব দুর্যোগ” বলছেন।

 বড় অঙ্কের এক শূন্যতা

  •  ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে রেজিস্ট্রেশন করেছিল: ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৯ জন
  •  পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে: ১০ লাখ ৫০ হাজার+
  •  অনুপস্থিত: সাড়ে ৪ লাখ+

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেই ফর্ম পূরণ করেনি প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে যেখানে প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসছে না।

দারিদ্র্যের রূপান্তরিত রূপ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএসসি পর্যায়ে পড়াশোনার গড় মাসিক খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা
কিন্তু বাংলাদেশের দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক আয়ের বড় অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে খাদ্য, বাসা ভাড়া এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে।

বিশ্বব্যাংক-এর তথ্য মতে:

  •  ২০২৫ সালে নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় এসেছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ
  •  COVID-19 পরবর্তী সময়ে নিম্নআয়ের পরিবারের আয় কমেছে ২৩%

স্কুল ছাড়ার পেছনের প্রধান কারণসমূহ

কারণ আনুমানিক প্রভাব
দারিদ্র্য ৪০%
শ্রমবাজারে প্রবেশ ২০%
বিদেশে কর্মসংস্থান ১০%
বাল্যবিবাহ ১৫%
কোচিং-টিউশনের খরচ ১৫%

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন:
“এসএসসি পাস করেই অনেক শিক্ষার্থী চাকরি বা বিদেশের পথে যাচ্ছে। আরেকটি বড় সমস্যা বিয়ে। এভাবে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকি

বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া তরুণদের কর্মজীবনে প্রবেশের পর দক্ষতা সংকট তৈরি হবে।
IMF সতর্ক করেছে:

  •  দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের পথে এগিয়ে যাবার গতিকে ধীর করে দিতে পারে।
  • ভবিষ্যতে সামাজিক বৈষম্য আরও তীব্রতর হবে।

UNICEF মন্তব্য করে:

“এটি শুধুমাত্র শিক্ষা সংকট নয়; বরং মানবসম্পদের নীরব দারিদ্র্য চক্রের সূচনা।”

ফারহানার গল্প: বাস্তব সংকটের প্রতিচ্ছবি

নারায়ণগঞ্জের রিকশাচালক শহিদুল ইসলামের মেয়ে ফারহানা এ বছর পরীক্ষায় বসতে পারছে না।

তার মা বলেন:

“প্রাইভেট, কোচিং আর স্কুলের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে মেয়েকে কাজ করতে পাঠিয়েছি।”

এমন হাজার হাজার ফারহানার গল্প আজ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে।

ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে:

  • আগামী এক বছরে আরও ৩০-৩২% শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে পারে।
  • মানবসম্পদ উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি তৈরি হবে।
  • বাল্যবিবাহ, বাল্যশ্রম ও সামাজিক অপরাধ বাড়বে।

সম্ভাব্য সমাধানের পথ

বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী সরকার নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে:

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য নগদ সহায়তা ও শিক্ষা ভর্তুকি
স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম চালু করা
কর্মমুখী শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ
বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন ১২তম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যকর করা
শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের নজরদারির মাধ্যমে ঝরে পড়া কমানো

সতর্কবার্তা

এইচএসসি পরীক্ষায় সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি এক জাতিগত বিপদের বার্তা। দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ ভয়াবহ দক্ষতা সংকট, বেকারত্ব এবং বৈষম্যের ফাঁদে আটকে পড়তে পারে।

এইচএসসি থেকে ঝরে পড়ছে লাখো শিক্ষার্থী: দারিদ্র্যের অদৃশ্য গ্রাসে দেশের ভবিষ্যৎ

০৬:০৯:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

বাংলাদেশের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ এক নীরব সংকট। এই বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না সাড়ে ৪ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। অর্থনৈতিক চাপে বিপর্যস্ত অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষা চালিয়ে নিতে পারছেন না। ফলে শিক্ষাজীবন থেমে যাচ্ছে মাঝপথে। বিশেষজ্ঞরা একে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মানবসম্পদের জন্য বড় ধরনের “নিরব দুর্যোগ” বলছেন।

 বড় অঙ্কের এক শূন্যতা

  •  ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে রেজিস্ট্রেশন করেছিল: ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৯ জন
  •  পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে: ১০ লাখ ৫০ হাজার+
  •  অনুপস্থিত: সাড়ে ৪ লাখ+

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেই ফর্ম পূরণ করেনি প্রায় ৭৫ হাজার শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে যেখানে প্রায় ৪০% শিক্ষার্থী পরীক্ষায় বসছে না।

দারিদ্র্যের রূপান্তরিত রূপ

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এইচএসসি পর্যায়ে পড়াশোনার গড় মাসিক খরচ দাঁড়িয়েছে ৩৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা
কিন্তু বাংলাদেশের দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মাসিক আয়ের বড় অংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে খাদ্য, বাসা ভাড়া এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে।

বিশ্বব্যাংক-এর তথ্য মতে:

  •  ২০২৫ সালে নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় এসেছে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ
  •  COVID-19 পরবর্তী সময়ে নিম্নআয়ের পরিবারের আয় কমেছে ২৩%

স্কুল ছাড়ার পেছনের প্রধান কারণসমূহ

কারণ আনুমানিক প্রভাব
দারিদ্র্য ৪০%
শ্রমবাজারে প্রবেশ ২০%
বিদেশে কর্মসংস্থান ১০%
বাল্যবিবাহ ১৫%
কোচিং-টিউশনের খরচ ১৫%

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান বলেন:
“এসএসসি পাস করেই অনেক শিক্ষার্থী চাকরি বা বিদেশের পথে যাচ্ছে। আরেকটি বড় সমস্যা বিয়ে। এভাবে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়া জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”

দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকি

বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া তরুণদের কর্মজীবনে প্রবেশের পর দক্ষতা সংকট তৈরি হবে।
IMF সতর্ক করেছে:

  •  দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের পথে এগিয়ে যাবার গতিকে ধীর করে দিতে পারে।
  • ভবিষ্যতে সামাজিক বৈষম্য আরও তীব্রতর হবে।

UNICEF মন্তব্য করে:

“এটি শুধুমাত্র শিক্ষা সংকট নয়; বরং মানবসম্পদের নীরব দারিদ্র্য চক্রের সূচনা।”

ফারহানার গল্প: বাস্তব সংকটের প্রতিচ্ছবি

নারায়ণগঞ্জের রিকশাচালক শহিদুল ইসলামের মেয়ে ফারহানা এ বছর পরীক্ষায় বসতে পারছে না।

তার মা বলেন:

“প্রাইভেট, কোচিং আর স্কুলের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বাধ্য হয়ে মেয়েকে কাজ করতে পাঠিয়েছি।”

এমন হাজার হাজার ফারহানার গল্প আজ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে।

ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক সংকেত

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুসারে, যদি বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে:

  • আগামী এক বছরে আরও ৩০-৩২% শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে পারে।
  • মানবসম্পদ উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি তৈরি হবে।
  • বাল্যবিবাহ, বাল্যশ্রম ও সামাজিক অপরাধ বাড়বে।

সম্ভাব্য সমাধানের পথ

বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী সরকার নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নিতে পারে:

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য নগদ সহায়তা ও শিক্ষা ভর্তুকি
স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম চালু করা
কর্মমুখী শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ
বাধ্যতামূলক শিক্ষা আইন ১২তম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যকর করা
শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের নজরদারির মাধ্যমে ঝরে পড়া কমানো

সতর্কবার্তা

এইচএসসি পরীক্ষায় সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি এক জাতিগত বিপদের বার্তা। দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আগামী এক দশকে বাংলাদেশ ভয়াবহ দক্ষতা সংকট, বেকারত্ব এবং বৈষম্যের ফাঁদে আটকে পড়তে পারে।