১০:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

ছাইয়ের ভেতর দগ্ধ বাংলাদেশের তরুণ স্বপ্ন

ভাঙা আস্থার দশ মাস

জুলাই ২০২৪-এর আন্দোলনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন টানা পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ধস নেমেছে শিল্পভিত্তি, দুর্বল হয়েছে বিনিয়োগ আস্থা, আর সেই ধাক্কা কাঁধে নিয়েছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী—কিন্তু এখন সবচেয়ে অসহায়—প্রাণশক্তি: ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ শ্রমশক্তি।

জিডিপির স্লিপ এবং অর্থনীতির নাভিশ্বাস

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৫-এ বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপির প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৩.৮ শতাংশে ঠেকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে । বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক South Asia Development Update-এ প্রক্ষেপণ আরও নিচে, ৩.৩ শতাংশ স্থলে দাঁড়িয়েছে, যার পেছনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে । একই সময়ে মুডিজ টানা দ্বিতীয়বার সার্বভৌম রেটিং-এ অবনমন ঘটিয়ে ২০২৫-এর প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে । প্রবৃদ্ধির এই সাপলুডুতে কোনো খাতে চাকরির ডাইস ঘুরছে না—আটকে আছে জায়গাতেই।

বেকার তরুণদের সংখ্যাতত্ত্ব

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ জানায়—মোট বেকার ২৭ লাখ; এর সিংহভাগই তরুণ। ২০২৪-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে যুব শ্রমশক্তি ৮ লাখ কমেছে, আর একই সময়ে বেকার বেড়েছে ২.৪ লাখ। আইএলওর World Employment and Social Outlook সতর্ক করেছে—তরুণ বেকারত্ব জাতীয় হারের দ্বিগুণের উপরে রয়ে যাবে।

জুলাই আন্দোলনের ছাই: পোড়া কারখানা ও চাপা সংকট

গত বছরের “জুলাই আন্দোলন”-এর সময় শ’ খানেক কারখানা ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের শিকার হয়; মালিকরা ক্ষতিপূরণ বা পুনর্গঠনের অর্থ জোগাতে না পারায় হাজার হাজার শ্রমিক আজও বসে আছেন বন্ধ গেটের সামনে । এই ক্ষত শুকোবার আগেই ব্যাংক খাতের ধুঁকুনি মালিকদের আরও অসহায় করে দিয়েছে—ঋণ পাবার দরজায় লাল তালা।

বিদেশি বিনিয়োগের শূন্যায়ন

রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় গত দশ মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো বহুজাতিক প্রকল্প অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে ২০২৪-এ নেট এফডিআই নামে মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । অর্থাৎ নতুন কারখানা, নতুন সফটওয়্যার সেন্টার, বা নতুন রিসার্চ ল্যাব—কিছুই দাঁড়াচ্ছে না; দাঁড়ানোর প্ল্যাটফর্মই নেই।

ভারত-স্নায়ুযুদ্ধ ও স্টার্ট-আপ শীত

চলমান কূটনৈতিক টানাপোড়েনে ভারত সীমান্ত পরিবহন-সুবিধা ও কিছু কাঁচামাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ জারি করেছে, আর ভারতীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল দ্রুত লগ্নি গুটিয়েছে। যার সরাসরি আঘাত পড়ছে ফিনটেক, এগ্রি-টেক, ই-কমার্সসহ ডিজিটাল খাতের নবীন উদ্যোক্তাদের উপর। স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেমে তাই এখন ‘ফান্ডিং উইন্টার’—ডালপালা ঝরছে, নতুন কুঁড়ি মেলছে না।

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ও রেমিট্যান্সের ফাটল

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে উপসাগরীয় শ্রমবাজার টালমাটাল। বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে নতুন ভিসা স্থগিত এবং প্রবাসী আয়ে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত পতন দেখা দিতে পারে । পাঁচ মাসে ১৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েও আশঙ্কা আছে—পরের কোয়ার্টার থেকেই প্রবাহ নিম্নমুখী হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা যেখানে রেমিট্যান্স-নির্ভর, সেখানে আয়ের এই ফাটল সরাসরি ঠেকবে গ্রাম-শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসা ও স্ব-নিয়োগে।

বিসিএস ফাঁদদক্ষতার ঘাটতি

প্রতি বছর ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন, কিন্তু সরকারি চাকরির নতুন পদ দশ হাজারের আশেপাশে। বিসিএস-কেন্দ্রিক কয়েক বছর ‘অপেক্ষা’ তরুণদের দক্ষতা ক্ষয় করে; অন্য দিকে নির্মাণ, সবুজ জ্বালানি, বা ডিজিটাল অবকাঠামো—সব খাতেই দক্ষ মিস্ত্রি-টেকনিশিয়ানের হাহাকার। কর্পোরেট সেক্টর তাই বিদেশি কর্মী এনে শূন্যস্থান পূরণে বাধ্য হচ্ছে; দেশীয় গ্র্যাজুয়েটরা পড়ে থাকছেন সিভি হাতে।

অদূর ভবিষ্যতের কালো রেখাচিত্র

আইএমএফ-এর ৩.৮ শতাংশ ও বিশ্বব্যাংকের ৩.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাঝামাঝি ধরা হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থনীতি সেরা হলেও সর্বোচ্চ ১১ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হবে। অথচ বাজারে প্রবেশ করবে কমপক্ষে ২৩ লাখ তরুণ। ঘাটতি প্রায় ১২ লাখ। ট্রেন্ড বজায় থাকলে ২০২৬-এর মাঝামাঝি বেকার তরুণের সংখ্যা ৩৫ লাখে পৌঁছাবে, আর “নিট”—যারা শিক্ষা, কাজ বা প্রশিক্ষণ কোথাও নেই—তাদের বাহিনী ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এটাই বাংলাদেশের সম্ভাব্য “ডেমোগ্রাফিক বোমা”।

ডিভিডেন্ড নাকি বিস্ফোরণ?

বাংলাদেশ একদা গর্ব করত—তরুণই তার মূল পুঁজি। কিন্তু পোড়া কারখানা, শুকনো এফডিআই, ঝুলে থাকা কূটনীতি, আর মধ্যপ্রাচ্যের বারুদগন্ধ—সব মিলিয়ে সেই পুঁজি এখন অনিশ্চিত সঞ্চয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখনও সম্ভাবনার জানালা বন্ধ করেনি, কিন্তু হুঁশিয়ার করে বলছে—সময়ের ঘুন পেছন থেকেই কামড়াচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, দক্ষতা বিপ্লব এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পাঞ্চলের পুনর্গঠন—এসব না-হলে কোটি তরুণের স্বপ্ন ভেঙে যাবে বেকারত্বের অতল গহ্বরে, আর “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড”-এর জায়গায় শব্দ হবে এক করুণ বিস্ফোরণ।

ছাইয়ের ভেতর দগ্ধ বাংলাদেশের তরুণ স্বপ্ন

০৩:৩১:৪১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

ভাঙা আস্থার দশ মাস

জুলাই ২০২৪-এর আন্দোলনের পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যেন টানা পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ধস নেমেছে শিল্পভিত্তি, দুর্বল হয়েছে বিনিয়োগ আস্থা, আর সেই ধাক্কা কাঁধে নিয়েছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী—কিন্তু এখন সবচেয়ে অসহায়—প্রাণশক্তি: ১৮-৩৫ বছর বয়সী তরুণ শ্রমশক্তি।

জিডিপির স্লিপ এবং অর্থনীতির নাভিশ্বাস

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৫-এ বাংলাদেশের প্রকৃত জিডিপির প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৩.৮ শতাংশে ঠেকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে । বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক South Asia Development Update-এ প্রক্ষেপণ আরও নিচে, ৩.৩ শতাংশ স্থলে দাঁড়িয়েছে, যার পেছনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত হয়েছে । একই সময়ে মুডিজ টানা দ্বিতীয়বার সার্বভৌম রেটিং-এ অবনমন ঘটিয়ে ২০২৫-এর প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে । প্রবৃদ্ধির এই সাপলুডুতে কোনো খাতে চাকরির ডাইস ঘুরছে না—আটকে আছে জায়গাতেই।

বেকার তরুণদের সংখ্যাতত্ত্ব

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ জানায়—মোট বেকার ২৭ লাখ; এর সিংহভাগই তরুণ। ২০২৪-এর প্রথম ত্রৈমাসিকে যুব শ্রমশক্তি ৮ লাখ কমেছে, আর একই সময়ে বেকার বেড়েছে ২.৪ লাখ। আইএলওর World Employment and Social Outlook সতর্ক করেছে—তরুণ বেকারত্ব জাতীয় হারের দ্বিগুণের উপরে রয়ে যাবে।

জুলাই আন্দোলনের ছাই: পোড়া কারখানা ও চাপা সংকট

গত বছরের “জুলাই আন্দোলন”-এর সময় শ’ খানেক কারখানা ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের শিকার হয়; মালিকরা ক্ষতিপূরণ বা পুনর্গঠনের অর্থ জোগাতে না পারায় হাজার হাজার শ্রমিক আজও বসে আছেন বন্ধ গেটের সামনে । এই ক্ষত শুকোবার আগেই ব্যাংক খাতের ধুঁকুনি মালিকদের আরও অসহায় করে দিয়েছে—ঋণ পাবার দরজায় লাল তালা।

বিদেশি বিনিয়োগের শূন্যায়ন

রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় গত দশ মাসে উল্লেখযোগ্য কোনো বহুজাতিক প্রকল্প অনুমোদন পায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে ২০২৪-এ নেট এফডিআই নামে মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন । অর্থাৎ নতুন কারখানা, নতুন সফটওয়্যার সেন্টার, বা নতুন রিসার্চ ল্যাব—কিছুই দাঁড়াচ্ছে না; দাঁড়ানোর প্ল্যাটফর্মই নেই।

ভারত-স্নায়ুযুদ্ধ ও স্টার্ট-আপ শীত

চলমান কূটনৈতিক টানাপোড়েনে ভারত সীমান্ত পরিবহন-সুবিধা ও কিছু কাঁচামাল রপ্তানিতে বিধিনিষেধ জারি করেছে, আর ভারতীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল দ্রুত লগ্নি গুটিয়েছে। যার সরাসরি আঘাত পড়ছে ফিনটেক, এগ্রি-টেক, ই-কমার্সসহ ডিজিটাল খাতের নবীন উদ্যোক্তাদের উপর। স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেমে তাই এখন ‘ফান্ডিং উইন্টার’—ডালপালা ঝরছে, নতুন কুঁড়ি মেলছে না।

মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ও রেমিট্যান্সের ফাটল

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে উপসাগরীয় শ্রমবাজার টালমাটাল। বিশ্লেষকদের মতে, সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে নতুন ভিসা স্থগিত এবং প্রবাসী আয়ে ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত পতন দেখা দিতে পারে । পাঁচ মাসে ১৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েও আশঙ্কা আছে—পরের কোয়ার্টার থেকেই প্রবাহ নিম্নমুখী হবে। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা যেখানে রেমিট্যান্স-নির্ভর, সেখানে আয়ের এই ফাটল সরাসরি ঠেকবে গ্রাম-শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসা ও স্ব-নিয়োগে।

বিসিএস ফাঁদদক্ষতার ঘাটতি

প্রতি বছর ২২ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করেন, কিন্তু সরকারি চাকরির নতুন পদ দশ হাজারের আশেপাশে। বিসিএস-কেন্দ্রিক কয়েক বছর ‘অপেক্ষা’ তরুণদের দক্ষতা ক্ষয় করে; অন্য দিকে নির্মাণ, সবুজ জ্বালানি, বা ডিজিটাল অবকাঠামো—সব খাতেই দক্ষ মিস্ত্রি-টেকনিশিয়ানের হাহাকার। কর্পোরেট সেক্টর তাই বিদেশি কর্মী এনে শূন্যস্থান পূরণে বাধ্য হচ্ছে; দেশীয় গ্র্যাজুয়েটরা পড়ে থাকছেন সিভি হাতে।

অদূর ভবিষ্যতের কালো রেখাচিত্র

আইএমএফ-এর ৩.৮ শতাংশ ও বিশ্বব্যাংকের ৩.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাঝামাঝি ধরা হলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে অর্থনীতি সেরা হলেও সর্বোচ্চ ১১ লাখ নতুন চাকরি তৈরি হবে। অথচ বাজারে প্রবেশ করবে কমপক্ষে ২৩ লাখ তরুণ। ঘাটতি প্রায় ১২ লাখ। ট্রেন্ড বজায় থাকলে ২০২৬-এর মাঝামাঝি বেকার তরুণের সংখ্যা ৩৫ লাখে পৌঁছাবে, আর “নিট”—যারা শিক্ষা, কাজ বা প্রশিক্ষণ কোথাও নেই—তাদের বাহিনী ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এটাই বাংলাদেশের সম্ভাব্য “ডেমোগ্রাফিক বোমা”।

ডিভিডেন্ড নাকি বিস্ফোরণ?

বাংলাদেশ একদা গর্ব করত—তরুণই তার মূল পুঁজি। কিন্তু পোড়া কারখানা, শুকনো এফডিআই, ঝুলে থাকা কূটনীতি, আর মধ্যপ্রাচ্যের বারুদগন্ধ—সব মিলিয়ে সেই পুঁজি এখন অনিশ্চিত সঞ্চয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এখনও সম্ভাবনার জানালা বন্ধ করেনি, কিন্তু হুঁশিয়ার করে বলছে—সময়ের ঘুন পেছন থেকেই কামড়াচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, দক্ষতা বিপ্লব এবং ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পাঞ্চলের পুনর্গঠন—এসব না-হলে কোটি তরুণের স্বপ্ন ভেঙে যাবে বেকারত্বের অতল গহ্বরে, আর “ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড”-এর জায়গায় শব্দ হবে এক করুণ বিস্ফোরণ।