বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক প্রফুল্ল রায় প্রয়াত হয়েছেন। ১৯৩৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর জেলার আটপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এই সাহিত্যিক ২০২৫ সালের ১৯ জুন, ৯০ বছর বয়সে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য হারাল এক জনজীবনের অনন্য কথাকারকে, যিনি সাহিত্যের মঞ্চে তুলে এনেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত ও প্রান্তিক মানুষের মুখচ্ছবি।
উদ্বাস্তু জীবনের শুরু
পূর্ববঙ্গের গ্রামের শিশুকাল থেকেই প্রফুল্ল রায়ের জীবনে ছায়া ফেলেছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তিনি কিশোর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া, খাদ্য, বাসস্থান ও নিরাপত্তার সংকটে বেড়ে ওঠা—এই অভিজ্ঞতা তাঁকে কেবল একজন সচেতন মানুষই করেননি, ভবিষ্যতের সাহিত্যিক হিসেবে গভীর বীজ বপন করে দেয়।
তাঁর শৈশবের মাটি হারানোর বেদনা, আত্মপরিচয়ের টানাপোড়েন, ও রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা পরবর্তীতে তাঁর বহু উপন্যাস ও গল্পের প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে।
নাগাল্যান্ড থেকে সাহিত্যিক পথচলা
প্রফুল্ল রায়ের সাহিত্যজীবনের শুরুটা ছিল ব্যতিক্রমী। সরকারি চাকরির কারণে তিনি নাগাল্যান্ডে দীর্ঘ সময় কাটান। পাহাড়ি সমাজ, আদিবাসী জীবন, এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ তাঁকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।
এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পূর্ব-পার্বতী’ (১৯৫৬) রচিত হয়। এই উপন্যাসেই তিনি একাধারে পরিবেশ, রাজনীতি ও ব্যক্তিগত টানাপোড়েনকে যুক্ত করেন। পরবর্তী সাহিত্যিক জীবনে এই রীতিই হয়ে ওঠে তাঁর লেখার মূলভিত্তি।
সমাজের নীচুতলার কণ্ঠস্বর
প্রফুল্ল রায় বারবার লিখেছেন তাঁদের নিয়ে, যাঁরা সাহিত্য বা ইতিহাসের মূলধারায় সাধারণত উপেক্ষিত। তাঁর চরিত্ররা কখনও আদিবাসী, কখনও উদ্বাস্তু, কখনও শ্রমজীবী, কিংবা অতি সাধারণ কোনো নার্স। মধ্যবিত্ত বাঙালির চেনা জগৎ থেকে তাঁদের অবস্থান আলাদা, আর সেই জায়গা থেকেই উঠে এসেছে সাহিত্যের নতুন দিগন্ত।
তাঁর ‘আকাশের নিচে মানুষ’, ‘নোনা জল মিঠে মাটি’, ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’ ও ‘কেয়া পাতার নৌকো’—সবখানেই তিনি এঁকেছেন সামাজিক বাস্তবতার ক্যানভাস।
উদ্বাস্তু জীবনের সাহিত্যিক ত্রয়ী
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী ত্রয়ী হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁর তিনটি উপন্যাস—‘কেয়া পাতার নৌকো’, ‘সতধারায় বয়ে যায়’ এবং ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’। এই তিনটি উপন্যাস মিলিয়ে উদ্বাস্তু জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ, বাস্তবধর্মী ইতিহাসচিত্র গড়ে উঠেছে।
- ‘কেয়া পাতার নৌকো’মূলত উদ্বাস্তুদের সংগ্রাম ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান নিয়ে।
- ‘শতধারায় বয়ে যায়’-এ উঠে আসে একাধিক প্রজন্মের মাঝে পরিচয় সংকট ও সমাজবাস্তবতার জটিলতা।
- ‘উত্তাল সময়ের ইতিকথা’রাজনৈতিক আন্দোলন, যুদ্ধ ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে মানুষের টিকে থাকার কাহিনি।
এই উপন্যাসগুলো প্রমাণ করে, ইতিহাসের পাঠ কেবল রাষ্ট্রের দলিলে নয়, সাহিত্যের পাতাতেও লেখা যায়।
নারীচরিত্র: সাহস ও বোধের প্রতীক
প্রফুল্ল রায়ের লেখায় নারীরা কখনও অসহায় নয়, বরং সচেতন, সংগ্রামী ও প্রতিবাদী। তাঁর ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ এমন এক নারীর গল্প, যে একাধারে বঞ্চিত, তবু নিজের স্বাধীনতা রক্ষায় আপসহীন।
নারীর আত্মপরিচয়, শ্রম, ভালোবাসা ও সামাজিক প্রতিরোধ প্রফুল্ল রায়ের সাহিত্যে বারবার এসেছে বাস্তব ঘ্রাণে। তিনি নারীদের নিয়ে ‘উপেক্ষার প্রতিচ্ছবি’ আঁকেননি, বরং তাঁদের নিজস্ব অবস্থানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
ছোটগল্প ও জীবনের ক্ষুদ্র অনুরণন
প্রফুল্ল রায়ের ছোটগল্পের সংখ্যা তিন শতাধিক। ‘প্রথম তারার আলো’, ‘অতৃপ্ত’, ‘মোহনার দিকে’, ‘অন্ধকারের মুখ’—প্রতিটি গল্পে জীবনের এক ঝলক প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর ভাষা সরল হলেও ভাবনায় গভীরতা, চরিত্র নির্মাণে বাস্তবতা এবং বর্ণনায় নাটকীয়তা রয়েছে।
তাঁর গল্পগুলোয় পাঠক চেনেন পরিচিত গন্ধ—নিম্নবর্গের নিঃশব্দ কান্না, জীবনের ছোট ছোট আনন্দ, কিংবা একফোঁটা আশা।
সাহিত্যে থেকে সিনেমায়
প্রফুল্ল রায়ের বহু রচনার চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনে রূপান্তর ঘটেছে। প্রায় ৪৫টি উপন্যাস ও গল্প সিনেমা বা ধারাবাহিকে রূপ পেয়েছে।
- ‘বাঘ বন্দি খেলা’(১৯৭৫): উত্তম কুমারের অভিনয়ে ‘প্রথম তারার আলো’ অবলম্বনে নির্মিত।
- ‘চরাচর’(১৯৯৩): আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত।
- ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’(২০০২): গৌতম ঘোষ পরিচালিত এই ছবি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে।
এই চলচ্চিত্রগুলো প্রমাণ করে, তাঁর সাহিত্য কেবল পাঠযোগ্য নয়, দর্শনযোগ্যও।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
প্রফুল্ল রায় তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার পেয়েছেন:
- বঙ্কিম পুরস্কার(১৯৮৫) – উপন্যাস ‘আকাশের নিচে মানুষ’।
- সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার(২০০৩) – উপন্যাস ‘ক্রান্তিকাল’।
- এছাড়াও ভাস্কর পুরস্কার,মতিলাল পুরস্কার, জীবনকৃতি সম্মানসহ অসংখ্য স্বীকৃতি।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—তাঁর মতো একজন লেখক মূলধারার একাডেমিক বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে খুব বেশি জায়গা পাননি। অথচ তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জন-লেখক।
উত্তরাধিকার ও প্রস্থান
প্রফুল্ল রায়ের জীবন যেমন নিঃশব্দে শুরু হয়েছিল, তেমনি নিঃশব্দেই শেষ হলো। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া সাহিত্য বাংলা সমাজকে আরও গভীরভাবে চিনতে শেখাবে। উদ্বাস্তু মানুষের অদৃশ্য বেদনা, নারীর স্বর, সমাজের প্রান্তবর্তী মানুষের জীবনের সত্যতা—এসবই তাঁর সাহিত্যকে কালোত্তীর্ণ করে তুলেছে।
যাঁরা বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তর ক্যানভাসে বাস্তবতাকে খুঁজে পেতে চান, তাঁদের জন্য প্রফুল্ল রায়ের রচনাসম্ভার অব্যর্থ নির্দেশনা।
প্রফুল্ল রায় ছিলেন জনমানুষের কথা বলার লেখক। কোনো বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধি নন, বরং একটি সমাজের, একটি সময়ের এবং বহু প্রজন্মের কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় ইতিহাস আছে, রাজনীতি আছে, আর আছে নীরব অথচ দৃপ্ত প্রতিবাদ।
বাংলা সাহিত্য আজ আরও একবার নিজের শিকড় ছুঁয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করবে, যখনই কোনো পাঠক প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাসের পাতা ওল্টাবে।