ঢাকার উত্তরের প্রাণরেখা হিসেবে খ্যাত তুরাগ নদী এক সময় ছিল সুপ্রশস্ত, স্বচ্ছ ও জীবন্ত জলাধার। গাজীপুরের সাল বন ঘেঁষে বয়ে এসে এটি মিরপুরে বুড়িগঙ্গায় মিশত; নদীপথে মানুষের যাতায়াত, কৃষিপণ্য ও পাট ব্যবসা—সবই চলত অবিরাম। আজ সেই নদী দখল-দূষণে সংকুচিত ও বিষাক্ত। তুরাগের
স্বর্ণযুগ (১৯৬০-এর দশক)
ষাটের দশকে গড় প্রস্থ ছিল প্রায় দুইশো মিটার, গড় গভীরতা সাড়ে তেরো মিটার; বর্ষায় নদী ফুলে-ফেঁপে উঠত আরও বিস্তীর্ণ হয়ে । ঢাকা-আশুলিয়া-গাজীপুর দু’পারে ছিল ঘন শাল বন; ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান এলাকায় প্রাথমিক ও গড়ে ওঠা গাছের ছায়ায় বন্যপ্রাণের বিচরণ ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য । নদীপথে কাঠ, পাট, চাল-ডাল ও মাটি দিয়ে তৈরি কলসি ইত্যাদি পাঠানো হতো বুড়িগঙ্গা ধরে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে, আবার বাঁশ-কাঠের ভেলা ভেসে যেত ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা পেরিয়ে মেঘনায়।
সংযোগ ও যোগাযোগের জাল
তুরাগের উৎস টাঙ্গাইল-গাজীপুর সীমান্তের বংশী; পথে টঙ্গী খালের মাধ্যমে বালু-বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঢাকাকে ঘিরে একটি প্রাকৃতিক আংটি (রিং) গড়ে তোলে । সে সময় ঢাকার উত্তরের গ্রামীণ হাটগুলো ছিল নদীকেন্দ্রিক; সকালে বন-গজারি কাঠ, পাটের আঁশ, শাকসবজি ও দুধের কলসি নৌকায় তোলা হতো, বিকেলে সেসব পণ্য পৌঁছাত পুরান ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে।
মাছ-ভরা নদী, জেলে-ভরা ঘাট
১৯৭০-এর দিকে তুরাগ-বংশী-বুড়িগঙ্গা মিলিয়ে কমপক্ষে ১২০ জাতের দেশি মাছ পাওয়া যেত—রুই, কাতলা, মৃগেল থেকে শুরু করে গোলসা, বেলে, পাবদা, কালবাউস প্রভৃতি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ৭১ প্রজাতি শনাক্ত হওয়ার মধ্যেই বড় ধসের ইঙ্গিত মেলে । আশুলিয়া-কাউনিয়া-বিরুলিয়ার ঘাটঘাটে অন্তত ৫-৬শ পরিবার পুরোদমে পেশাদার জেলে ছিল; বর্ষাকাল এলে সংখ্যাটা আরও বাড়ত । নদীর মাছই ছিল তাদের একমাত্র জীবিকা ও পুষ্টি-নির্ভরতা।
বর্ষা ও মাঠজলের নিগূঢ় সম্পর্ক
মনসুনে পাহাড়ি ঢল আর প্রবল বৃষ্টি মিলিয়ে তুরাগের পানি দু’কূল ছাপিয়ে আশুলিয়া-দিয়ারিকান্দা-শ্রীপুর-সদরে বিস্তীর্ণ নিচু মাঠ প্লাবিত করত। এই ‘মাঠজল’ চার-পাঁচ মাস ধরে থাকত; ধানের ক্ষেতে পলি পড়ত, মাছের পোনা ছড়িয়ে পড়ে বৈচিত্র্য বাড়ত । এলাকাবাসীর ভাষায়, ‘বর্ষার সাথে সাথে নদী এল মাঠে, আর মাঠ ঢুকল নদীর ভেতর।’ ফলস্বরূপ ধানের পাশাপাশি নানা শীতকালীন শাক-সবজির উৎপাদন বাড়ত।
পতনের শুরু: শিল্পায়ন, দখল ও দূষণ
টঙ্গী বিসিক শিল্পাঞ্চল ও গাজীপুর-সাভারের বিক্ষিপ্ত কারখানা গড়ে ওঠা শুরু করে সত্তরের শেষ ভাগে; ১৯৮০-এর দশকে তরল বর্জ্য সরাসরি খাল-নদীতে ফেলা পড়ে। ধীরে ধীরে নদীপাড় দখল করে গড়ে ওঠে ইটভাটা, অবৈধ বসতি ও দোকানপাট; ২০০৯-এর হাইকোর্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও দখলদারদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলে । সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৫ বছরে দূষণস্তর প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে; ৩৮টি স্লুইসগেট, ৬২টি সেবা খাল ও ৪৪১টি ডাম্পিং পয়েন্ট নদীকে বিষিয়ে তুলছে ।
বনের ক্ষয়, নদীর শ্বাসরোধ
গাজীপুর জেলায় ২০০০-এর তুলনায় ২০২৩-এ সাল বন ও অন্যান্য বনভূমি ৬০ শতাংশের বেশি হারিয়েছে; একইসময়ে জলাশয় কমেছে অর্ধেকেরও বেশি । বন কাটার ফলে মাটির ধরন বদলেছে, পানির ধারণক্ষমতা কমেছে এবং ভাঙন-পলি জমে নদীর গভীরতা-প্রস্থ কমতে শুরু করেছে।
আজকের তুরাগ: কালো জল, সংকুচিত বহমানতা
শীতকালে কোথাও কোথাও প্রস্থ নেমে আসে মাত্র ৩০ মিটার; পানির রঙ চায়ের মতো কালচে, দ্রবীভূত অক্সিজেন ২ মি.লি./লিটারের নিচে, যা মাছ-অন্তহীনতার সংকেত । দূষণ ও দখলমুক্ত রাখার দাবিতে ২০১৬-তে নাগরিকরা ‘টাইম টু ডিক্লেয়ার তুরাগ ডেড’ শ্লোগান তুললেও পানি উন্নয়ন, নৌ-পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিএ-র সমন্বয় প্রক্রিয়া ধীর ।
জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব সংকট
২০১৩-১৭-এর মধ্যে সরেজমিন জরিপে মাছের প্রজাতি ৭১-এ নেমে এসেছে, যার মধ্যে ১৫ প্রজাতি মহাবিপন্ন । জলজ উদ্ভিদ—শাপলা, হিজল-করচ, কচুরিপানা—দূষিত পানিতে পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। জেলেদের ৭০ শতাংশই পেশা বদল করে নির্মাণশ্রমিক ও রিকশাচালক হয়েছেন ।
পুনরুদ্ধারের ক্ষীণ আলোকরেখা
২০২৫-এর মে মাসে পরিবেশমন্ত্রী পুনরুদ্ধার প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে জানিয়েছেন; পর্যায়ক্রমে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, ইটভাটা বন্ধ, বর্জ্যশোধনাগার স্থাপন ও জিও-ব্যাগ দিয়ে তীররক্ষা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে । শিল্পমালিকদের আধুনিক ইটিপি স্থাপন ও সক্রিয় করার জন্য কঠোর নজরদারি ঘোষণা করেছে পরিবেশ অধিদফতর; একইসঙ্গে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ বিবেচনাধীন।
একদা যে ছিলো প্রধান ধমনী
তুরাগ একদা ছিল ঢাকার উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্যের প্রধান ধমনী, বন্যার সময় মাঠজলের জীবনরস আর শুষ্ক মৌসুমে নৌ-যোগাযোগের নিরন্তর পথ। মাত্র কয়েক দশকের দখল-দূষণে সেই নদী আজ মৃতপ্রায়। তবু এখনও যদি অবৈধ দখল উচ্ছেদ, দূষণ-নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন ও জলাধার-পুনরুদ্ধার সমন্বিতভাবে করা যায়, তবে তুরাগ আবারও হতে পারে জীবনের জায়গা। নদী বাঁচলে শুধু ইতিহাস নয়—ঢাকার প্রাণ, কৃষি, পরিবেশ এবং হাজারো মানুষের জীবিকা-নির্ভরতাও বাঁচবে। এখন প্রশ্ন, কেউ কী সত্যিই সেই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত?