যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বিশ্বজুড়ে বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তর (USDA) সম্প্রতি প্রথমবারের মতো পোলট্রি খাতে টিকা ব্যবহারের পরিকল্পনা তৈরি করছে। প্রায় ১৭ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মুরগি ও টার্কি পাখি ২০২২ সালের পর থেকে নিধন করা হয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে, কারণ বাংলাদেশও অতীতে বার্ড ফ্লুর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের শিকার হয়েছে।
বাংলাদেশের ঝুঁকি
বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প দেশের অন্যতম বড় খাত। দেশের ৬০% প্রোটিন চাহিদা আসে ডিম ও মুরগি থেকে। প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার পোলট্রি বাণিজ্য দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে। কিন্তু এর পাশাপাশি বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়লে তা শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়ে।
সর্বশেষ ২০২৩ সালে কক্সবাজার, গাজীপুর ও নওগাঁতে ছোটখাটো বার্ড ফ্লু আউটব্রেক দেখা গেছে। তখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সতর্ক পদক্ষেপ নিয়ে পাখি নিধন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে প্রতিবছর শীত মৌসুমে বার্ড ফ্লুর ঝুঁকি বাড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের মডেল থেকে কী শেখা যায়?
যুক্তরাষ্ট্রের টিকা প্রস্তাবনায় যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে—
- শিশু মুরগিকে প্রাথমিক টিকা দেওয়া হবে।
- পরবর্তী সময়ে বুস্টার ডোজ ও নিয়মিত ফ্লক টেস্ট করা হবে।
- আক্রান্ত পাখি ধরা পড়লে তা নষ্ট করা হবে।
এটি এমন একটি হাইব্রিড মডেল যা টিকাদান ও সতর্ক তদারকির সমন্বয়ে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধ করবে। বাংলাদেশ চাইলে এ ধরনের একটি মডেল নিজস্ব বাস্তবতায় রূপ দিতে পারে।
বাংলাদেশে সম্ভাব্য কৌশল
পাইলট প্রকল্প চালু: প্রাথমিকভাবে বড় খামারে (যেমন সাভার, গাজীপুর, টাংগাইল) শিশু মুরগির ওপর টিকা কার্যক্রম চালানো যেতে পারে।
ট্রেড ঝুঁকি মূল্যায়ন: যেহেতু অনেক দেশ টিকাগ্রহণকারী পোলট্রি পণ্যের আমদানি নিষেধ করে, তাই রপ্তানির দিক বিবেচনা করে আলাদা চিহ্নিতকরণ ও ট্রেসেবিলিটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।
বিশ্বব্যাংক ও FAO-র সহায়তায় গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ: বাংলাদেশ যদি খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমাল হেলথ (WOAH) এর সঙ্গে সমন্বয়ে কাজ করে, তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত গবেষণা ও অনুদান পেতে পারে।
ডিম বনাম মাংস উৎপাদকদের মধ্যে সমন্বয়: যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে ডিম উৎপাদকরা টিকাদানের পক্ষে এবং মাংস উৎপাদকরা বিপক্ষে, বাংলাদেশেও তেমন মতভেদ থাকতে পারে। তাই আগেই সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
পোলট্রি চিকিৎসা ও টেস্টিং ল্যাব উন্নয়ন: নিয়মিত নমুনা সংগ্রহ ও জেনেটিক সিকোয়েন্সিং-এর মাধ্যমে ভাইরাসের ধরন শনাক্ত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।
চ্যালেঞ্জ
- রোগ শনাক্ত না হয়ে টিকায় চাপা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি।
- সঠিকভাবে বুস্টার ডোজ না দিলে ভাইরাস রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে পারে।
- মাঠপর্যায়ে সরকারি টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের সক্ষমতা ও পর্যবেক্ষণ দুর্বলতা।
বিশেষজ্ঞ মত
জাতীয় পোলট্রি ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি মো. মঞ্জুর হোসেন বলেন, “আমাদের প্রথমে দেশের বিজ্ঞানীদের দিয়ে একটি পরীক্ষামূলক গবেষণা করতে হবে—টিকা কতটা কার্যকর, ভাইরাস রূপ পরিবর্তন করলে কী হবে ইত্যাদি বুঝে তবেই দেশজুড়ে প্রয়োগ করতে হবে।”
প্রাণিসম্পদ গবেষক ড. ফারহানা জাহান বলেন, “আমাদের জলাভূমি ও অভিবাসী পাখির মাধ্যমে বার্ড ফ্লু ছড়ানোর বড় ঝুঁকি আছে, তাই শুধু খামারে নয়, খামারের বাইরের জীববৈচিত্র্যও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ আমাদের সামনে একটি কার্যকর পথ খুলে দিয়েছে—টিকাদান, পর্যবেক্ষণ ও রপ্তানি ঝুঁকির ভারসাম্য বজায় রেখে বাংলাদেশ বার্ড ফ্লু মোকাবিলায় একটি স্থায়ী সমাধানের দিকে এগোতে পারে। এখন প্রয়োজন একটি সমন্বিত, বিজ্ঞানভিত্তিক ও বাস্তবভিত্তিক ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান।