বাংলা সাহিত্যে নির্মলেন্দু গুণ এমন এক কণ্ঠস্বর, যিনি শুধু প্রেম কিংবা প্রকৃতির কবি নন, বরং গণমানুষের বেদনা, রাষ্ট্রের সংঘাত, সংগ্রামের দীর্ঘ রেখা ও স্বপ্নের ব্যাকরণে এক বিশাল কবিতার মহাবৃক্ষ। তাঁর লেখায় বারবার ফিরে আসে স্বাধীনতা শব্দটি—কখনো প্রশ্ন হিসেবে, কখনো প্রতিজ্ঞা হয়ে, কখনো চেতনার দীপ্ত উচ্চারণ হিসেবে। স্বাধীনতা কীভাবে আমাদের হলো—এই প্রশ্নটির কাব্যিক উত্তরে তিনি তুলে ধরেন এক জাতির ইতিহাস ও আত্মত্যাগ।
২০২৫ সালের ২১ জুন কবির ৮০তম জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমরা ফিরে তাকাই এক অনন্য প্রতিভার জীবন ও সাহিত্যভুবনের দিকে।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
নির্মলেন্দু গুণ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৫ সালের ২১ জুন নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টার কাশবন গ্রামে। পিতা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী এবং মা বীণাপাণি দেবী। মাত্র চার বছর বয়সে মাতৃহীন হয়ে ওঠা শিশুটি গ্রামীণ পরিবেশে বড় হন নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। ১৯৬২ সালে মেট্রিক ও ১৯৬৪ সালে আইএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ১৯৬৯ সালে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বিএ পাস করেন।
কবিতার শুরু ও বিপ্লবের ছায়া
নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। এই গ্রন্থের “হুলিয়া” কবিতা তাঁকে শুধু জনপ্রিয়ই করেনি, পরিণত করেছে এক রাজনৈতিক প্রতিবাদের কবিতে। সেই কবিতার ভাষা ছিল যেন রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক অশ্রুসিক্ত উচ্চারণ:
“তোমার খোঁজে পুলিশ এসেছে, বলো মা আমি কোথায় যাবো…”
এই কবিতায় স্বৈরাচার, পলাতক যুবকের বেদনা ও মা-ছেলের সম্পর্ক এক অদ্ভুত মিশ্রণে হৃদয় কাঁপায়। সে সময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনের গর্জন “হুলিয়া”-র শব্দে প্রতিফলিত হয়।
‘স্বাধীনতা’ শব্দটির কাব্যিক উৎস
নির্মলেন্দু গুণের সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রভাবশালী কবিতাগুলোর একটি হলো “স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো”। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে কেন্দ্র করে লেখা এই কবিতাটি শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং কবির কণ্ঠে জাতির চেতনার গৃহস্থালি।
কবিতাটিতে তিনি দেখান যে, এই ‘স্বাধীনতা’ একদিনে আসেনি; এটি এসেছে শ্রমিকের হাতঘাম, শহীদের রক্ত, কৃষকের আশা, কবির কান্না, নারীর চোখের জল আর নেতার ঘোষণা থেকে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”—এই একটি বাক্য দিয়েই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির শুরু।
এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘স্বাধীনতা’কে কেবল রাষ্ট্রীয় ঘোষণার বিষয় নয়, বরং আত্মিক অর্জন, সম্মিলিত চেতনা এবং সংগ্রামী ইতিহাসের ফলাফল হিসেবে স্থাপন করেন।
গুণের অন্যান্য বিশিষ্ট কবিতা
নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় রয়েছে সমাজতান্ত্রিক চেতনা, বিপ্লবী সাহস, প্রেম এবং মানুষের ন্যায্য অধিকারের আবেদন। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
• হুলিয়া: পলাতক যুবক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মর্মস্পর্শী দলিল।
• স্বাধীনতা, উলঙ্গ কিশোর: মুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়ানো কিশোরের প্রতিরূপ।
• মুজিব মানে মুক্তি: বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে জাতির স্বাধীনতার রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা।
• আমি কবি বলছি: কবির দায়িত্ব ও অবস্থান নির্ধারণে স্পষ্ট ভাষ্য।
• মানুষ: সাধারণ মানুষের জীবনবোধকে তুলে ধরা মানবিক কবিতা।
কবিতার ভাষা ও শৈলী
নির্মলেন্দু গুণের ভাষা সহজ, সরল, ছন্দময়। তাঁর কবিতায় অলংকারের বাহুল্য নেই, আছে মাটির গন্ধ। শহর ও গ্রামের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক অবদমন, প্রেমের অন্তর্জাগতিকতা ও মানবিক ব্যথা—সবই তিনি লিখেছেন গাঢ় আবেগে, অথচ পাঠকের বোধগম্যভাবে।
সাহিত্যচর্চা ও চিত্রশিল্প
কবিতা ছাড়াও নির্মলেন্দু গুণ গদ্য ও ভ্রমণলেখক হিসেবে পরিচিত। আমার ছোটবেলা, আমার কণ্ঠস্বর, আত্মকথা ১৯৭১ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে পড়ে। তিনি একজন চিত্রশিল্পীও। ২০০৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত তাঁর একক চিত্রপ্রদর্শনী তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার প্রমাণ দেয়।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
নির্মলেন্দু গুণ তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), একুশে পদক (২০০১) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৬)। এই তিন পুরস্কার তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সর্বোচ্চ সম্মান ও সামাজিক স্বীকৃতির প্রতীক।
প্রাসঙ্গিকতা ও উত্তরাধিকার
আজকের প্রজন্ম যখন গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নে জিজ্ঞাসু, তখন নির্মলেন্দু গুণের কবিতা তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা শুধু অতীতের বিষয় নয়, এটি চলমান এক সংগ্রাম। তাঁর কবিতা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত, মঞ্চে অভিনীত, এবং টিভি অনুষ্ঠানেও আলোচিত হয়। তাঁর একমাত্র কন্যা মৃত্তিকা গুণও সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত।
নির্মলেন্দু গুণ বাংলা সাহিত্যে এমন এক কবি, যিনি প্রেমের পাশাপাশি বিপ্লবকেও ভালোবেসেছেন। তাঁর কবিতায় স্বাধীনতা শুধু ভাষণের বিষয় নয়—তা একটি জীবন্ত, প্রবহমান অনুভব। যিনি আমাদের শিখিয়েছেন, ‘স্বাধীনতা’ একটি শব্দমাত্র নয়, এটি ইতিহাসের রক্তস্নাত অর্জন।
বাঙালির কণ্ঠে যখনই উচ্চারিত হয়—“এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো”, তখনই কবি নির্মলেন্দু গুণ স্মরণীয় হয়ে ওঠেন। কারণ সেই উচ্চারণে রয়েছে একটি কবির দায়, ইতিহাসের গতি, এবং ভবিষ্যতের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া আলো।