পুরনো ঢাকার প্রাণ ছিল এই খাল
এক শতাব্দী আগে ঢাকার মানচিত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খালের মধ্যে ঢোলাই খাল ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি জলপথ ছিল না, বরং ঢাকার অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
আজ যেখানে রয়েছে পিচঢালা রাস্তা, যানজট এবং ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকা শহর, সেখানে একসময় দুলে চলা পানির ধারে পরিবার নিয়ে বসে গল্প করতেন ঢাকাবাসী। ঢোলাই খাল ছিল তাদের যাত্রার পথ, বিনোদনের স্থান এবং খাদ্য-সংগ্রহের একটি প্রাকৃতিক উৎস।
খাল না হয়ে সেতু, রাস্তাই কেন?
ঢোলাই খাল প্রবাহিত হতো পুরানা পল্টন থেকে শুরু করে নাজিরাবাজার পর্যন্ত। এটি একটি প্রাকৃতিক খাল ছিল না—বলা হয়, মোগল আমলে নগর প্রতিরক্ষা ও পানিপথ উন্নয়নের উদ্দেশ্যে এটি খনন করা হয়। খালটি একদিকে বুড়িগঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অন্যদিকে শহরের অভ্যন্তরীণ বাজার ও আবাসিক এলাকার সঙ্গে।
ব্রিটিশ আমলে এই খাল হয়ে ওঠে ঢাকার বাণিজ্যিক প্রাণরেখা। সদরঘাটে নোঙর করা বড় নৌকা থেকে পণ্য খাল ধরে উঠে যেত পুরান ঢাকার প্রতিটি কোণায়। ব্যবসায়ীরা কাপড়, চাল, মসলা, কাঠ, মাছ ইত্যাদি খালপথে সরবরাহ করতেন। এই জলপথে মানুষও যাতায়াত করত—শুধু পরিবহন নয়, অনেকটাই সামাজিক বিনোদনের রূপে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মায়াজাল
বিশ শতকের প্রথমভাগে ঢোলাই খালের দুই পাড়ে ছিল সারি সারি নারকেল ও তালগাছ। বর্ষার সময় খাল জলে টইটম্বুর হয়ে যেত। খালটি ছিল ধীরে প্রবাহমান, শান্ত এবং দূষণমুক্ত। খালপাড়ে গৃহবধূদের গল্প করার মতো স্থান ছিল, শিশুরা খেলে বেড়াত এবং সন্ধ্যাবেলায় অনেকেই হাঁটতে বের হতেন খালের কিনার ঘেঁষে। ঢোলাই খালের পরিবেশটি তখন এতটাই নির্মল ও প্রাণবন্ত ছিল যে অনেকে একে “ঢাকার অভ্যন্তরীণ লাউঞ্জ” বলেই মনে করতেন। খালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকায় বসে চা খাওয়া, বাঁশি বাজানো বা গান গাওয়া ঢাকার সংস্কৃতির অংশ ছিল।
ঢোলাই খালের মাছ ও মৎস্যজীবী জীবনধারা
একসময় ঢোলাই খাল ছিল একটি জীবন্ত জলজ সম্পদ। এখানকার স্বচ্ছ ও প্রবাহমান জলে বাস করত নানা প্রজাতির মাছ। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে খাল-সংলগ্ন বিল, ধানক্ষেত ও নিচু জমিতে পানি জমলে সেখানে মাছের বিচরণ বেড়ে যেত। পরে সেই মাছ আবার খালে ফিরে আসত।
কী ধরনের মাছ পাওয়া যেত?
ঢোলাই খালে পাওয়া যেত দেশি মাছের ভাণ্ডার:
• পুঁটি, ট্যাংরা, কৈ – ছোট আকারের হলেও রান্নার জন্য জনপ্রিয় ছিল।
• শিং, মাগুর – বর্ষায় বেশি ধরা পড়ত, কারণ মাটির নিচে গর্ত করে এরা টিকে থাকতে পারত।
• রুই, কাতলা – কিছু বড় আকারের মাছ খালের গভীর অংশ ও নদীর সংযোগস্থলে ঘুরে বেড়াত।
• তেলাপিয়া – পরবর্তীকালে বিস্তার লাভ করে, খালে সহজেই প্রজনন করত।
• দেশি চিংড়ি – বর্ষায় খালে সামান্য নোনা জল মিশলে এরাও দেখা যেত।
ঢাকাবাসীর মাছ ধরার অভিজ্ঞতা
পুরান ঢাকার মানুষজন—বিশেষ করে নাজিরাবাজার, গেন্ডারিয়া, ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দারা—প্রতিদিন মাছ ধরতেন এই খালে। কেউ পরিবারিক প্রয়োজনে, কেউবা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে মাছ ধরতেন। সকালে শিশু-কিশোররা ছোট পলো বা বড়শি নিয়ে খালে নামত, সন্ধ্যায় বড়রা দল বেঁধে জাল ফেলতেন।
বর্ষাকালে এটি ছিল এক ধরনের উৎসব। ঈদের আগের দিন বা পূর্ণিমা রাতে মাছ ধরার প্রতিযোগিতাও হতো পাড়ায় পাড়ায়। খালের মাছ যেমন ছিল পুষ্টিকর, তেমনি সহজলভ্য ও প্রায় বিনা খরচে পাওয়া যেত।
মৎস্যজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ খাল থেকে ধরা মাছই বিক্রি করতেন বাজারে। এতে পরিবার চালানোর মতো আয় হতো। অর্থাৎ খাল শুধু খাবারের উৎস নয়, বরং জীবিকা অর্জনের এক মাধ্যমও ছিল।
ব্যবসা ও যোগাযোগের মূলধারা
ঢোলাই খাল পুরান ঢাকা এবং আশেপাশের এলাকার পণ্য সরবরাহ ও যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল। সদরঘাট থেকে নেমে আসা নৌকা ঢোলাই খাল হয়ে পৌঁছে যেত চকবাজার, বংশাল, নারিন্দা, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন বাজারে। জুতা, লুঙ্গি, চাল, মাছ থেকে শুরু করে কাঠ, ইট, নীলের বোঝাই হালকা নৌকা খাল বেয়ে শহরের প্রতিটি কোণে পৌঁছে যেত।
এই খালই ছিল পুরান ঢাকার “সাপ্লাই চেইন”-এর প্রধান লাইফলাইন। ব্যবসায়ীরা নদীপথে যে পণ্য আনতেন, তা খালের মাধ্যমেই দোকান পর্যন্ত পৌঁছাত। খালধারে বসবাসকারীদের অনেকে খালসংলগ্ন পণ্যবাহী নৌকার চালক বা মাল লোড-আনলোডের শ্রমিক হিসেবেও কাজ করতেন।
পতনের শুরু: পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন
ঢাকা শহরে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ার কারণে পঞ্চাশের দশক থেকেই ঢোলাই খালের দুই পাড়ে গড়ে ওঠে অবৈধ বসতি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। খালের উপর পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য ফেলা শুরু হয়। দখলদারদের নির্মমতায় খাল ক্রমশ সরু হতে থাকে।
ষাটের দশকে খালের পানির প্রবাহে কৃত্রিম বাধা দেওয়া শুরু হয়। জলাবদ্ধতা বাড়তে থাকে। আশেপাশের ছোট ছোট নালা-খাল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢোলাই খাল তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারায়। ধীরে ধীরে এটি এক মৃতপ্রায় জলধারায় পরিণত হয়।
সত্তরের দশকে খালে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আশির দশকে ঢাকা সিটি করপোরেশন ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ খালটি পুরোপুরি ভরাট করে পিচঢালা রাস্তা তৈরি করে। খালের স্থান দখল করে তৈরি হয় দোকানপাট, গ্যারেজ, রাস্তা ও বাসস্ট্যান্ড।
ধ্বংস না রক্ষা—কোনটা হতো ঢাকার জন্য ভালো?
নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিবেশবিদদের মতে, ঢোলাই খালকে রক্ষা করা হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি বড় সমাধান রক্ষা করা যেত। খালগুলো কেবল পরিবহন নয়, বরং প্রাকৃতিক নর্দমা হিসেবেও কাজ করত। শহরে প্রতিদিনের বৃষ্টির জল এসব খাল দিয়ে সহজেই নদীতে চলে যেত।
বর্তমানে ঢাকায় যে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও বৃষ্টির পরে দীর্ঘস্থায়ী পানি জমার সমস্যা দেখা দেয়, তা অনেকটাই ঠেকানো যেত ঢোলাই খালের মত খালগুলো সংরক্ষণ করলে। আর পরিবেশগত ভারসাম্য, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও এই খাল ছিল অপরিহার্য।
ইতিহাসকে স্মরণে রাখার দায়
ঢোলাই খাল এখন ইতিহাসের অংশ। এটি আজকের প্রজন্মের কাছে অচেনা এক নাম, কিন্তু একসময় ঢাকাবাসীর প্রাণ ছিল এই খাল। পণ্য আনা-নেওয়া, মাছ ধরা, নৌকা ভ্রমণ, খালপাড়ে বিকেলবেলা হাঁটা আর খালের পানিতে গলা ডুবিয়ে থাকা এক শিশুর মুখভরা হাসি—এসবই ছিল ঢাকার জীবনচিত্র।
এই ফিচার কেবল ঢোলাই খাল নয়, বরং ঢাকার হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক নগরবন্দনের একটা প্রতিচ্ছবি। শহর যখন কংক্রিটে মোড়ানো বন্দি হয়ে পড়ছে, তখন এই ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতির সঙ্গে বিরোধ নয়, বরং সহাবস্থানই টেকসই উন্নয়নের মূলমন্ত্র।
শেষকথা
ঢোলাই খাল বাঁচানো গেলে হয়তো আজকের ঢাকায় প্রতিদিনের জলাবদ্ধতা, বর্জ্যজট আর পরিবেশ দূষণ এতটা ভয়াবহ রূপ নিত না। শহরের হৃদয়ে এক ছায়াময়, সজীব জলপথ বয়ে চলত। এখন যা আছে তা শুধু স্মৃতি, নস্টালজিয়া আর কিছু পুরনো মানচিত্রের পাতায় ছাপা রেখা। সময় এসেছে ইতিহাসকে শিক্ষায় রূপান্তর করার।