০৭:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা ব্যর্থ কলম্বো, গলের লড়াই -এ বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঘরে জয় কেন ? ‘আকাশ হয়ে যাই’ মিউজিক ভিডিতে প্রশংসিত পূর্ণিমা বৃষ্টি সাউথ চায়নান মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন: ইরান আক্রমনে লাভ ক্ষতি ইউক্রেন দাবি করেছে বাংলাদেশের কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিক ইইউ কলকাতার কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রীকে গণধর্ষণ, গ্রেফতার তিন ‘চুরির গম’ আমদানি: বাংলাদেশের ওপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা চায় ইউক্রেন চীনের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র গ্যাসক্ষেত্রের দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎপাদন শুরু কেমন ছিলো শুক্রবারের কাঁচাবাজারের আবহাওয়া মাইক্রোক্রেডিটের ভাঙা প্রতিশ্রুতি: কেন কিছু ঋণগ্রহীতা বলছেন “আর না”

রূপসা নদী: এক খাল কাটা স্বপ্ন থেকে দক্ষিণের প্রবেশদ্বার

শুরুর সেই দিনটি

উনিশ শতকের মাঝামাঝি। নড়াইলের লবণ ও কাঠ ব্যবসায়ী রূপচাঁদ সাহা ভাবলেন, ভৈরব দিয়ে কলকাতামুখী পণ্য পাঠাতে বারবার বাঁক নিতে গিয়ে সময় নষ্ট হয় কেন? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজ খরচে কাটবেন একটি ছোট খাল। স্বপ্নটির নাম হয়ে গেল ‘রূপ সাহার খাল’। ভৈরবের স্রোত ও বন্যার খেয়ালে সেই সরু জলপথ দ্রুতই প্রশস্ত হয়ে রূপ নেয় এক পূর্ণাঙ্গ নদীর—আমাদের চেনা রূপসা।

পথরেখা ও চরিত্র

ভৈরব ও মধুমতী মিলে খুলনার পূর্ব প্রান্তে যে বিস্তৃত জলধারা গড়ে তোলে, সেটিই রূপসা। উত্তরে নড়াইলের নবগঙ্গা–কুমার–চিত্রা নদীগুচ্ছ এসে ভৈরবে মিশে জলপথকে আরও প্রশস্ত করে, আর দক্ষিণে রূপসা নেমে পশুর নদীতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে হারিয়ে যায়। এই নদীপথই একসময় যশোর–নড়াইল অঞ্চলের পাট, ধান, মাছ, এমনকি নকশিকাঁথার আড়ত ভরাত খুলনা শহরের ঘাটে।

নদীকেন্দ্রিক খুলনার কোলাহল

একশো বছর আগে—বিশ শতকের তৃতীয় দশকে—খুলনা ছিল শব্দে-গন্ধে এক নদীবন্দরনির্ভর নগরী। রূপসা ঘাটে নোঙর ফেলত পাট ও চামড়া-বোঝাই বড় নৌকা, ‘রকেট’ প্যাডেল স্টিমার, কাঠ-চালিত বার্জ। নদীর ধারেই গড়ে উঠেছিল জুট গুদাম, রেলস্টেশন, আদালত, বাজার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নদীর ঢেউ যেন তখন শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ত।

নড়াইলযশোর থেকে কলকাতা: বাণিজ্যের সোনালি রুট

চিত্রা–নবগঙ্গা টপকে নড়াইল হাটের পাট-বোঝাই নৌকা রূপসা ধরে খুলনায় আসত। এখান থেকে স্টিমারে চেপে সোজা কলকাতার বাবুগাট বা গুয়ারি ঘাট। ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম ন্যাভিগেশন কোম্পানির ভাটিয়ালি সুরময় হুইসেলেই ছিল ইংরেজ শাসিত ভারতে অন্যতম ব্যস্ত নৌরুটের সিগন্যাল।

সড়করেলের যুগে রূপসা

খান জাহান আলী সেতু (২০০৫) ১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কসেতু খুলনা–বাগেরহাট মহাসড়কের গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার তখন থেকেই খুলনা।

রূপসা রেল সেতু (২০২৩) ৫.১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ধাতব পালকে মুকুটখচিত। খুলনা থেকে মংলা বন্দরে এখন পণ্যবোঝাই ট্রেন যায় একটানা, বাণিজ্য-সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় বহুগুণ।

নদীর সংসার: মাছ ও মানুষ

২০১৬-এর সমীক্ষা বলছে রূপসায় এখনো ৬২টি মাছের প্রজাতির বাস। রুই-কাতলা প্রচুর, ইলিশ-বাঘাইড় নদীর প্রাণ। তবে দূষণ ও নাব্যহ্রাসে অন্তত নয়টি প্রজাতি সংকটে। নদী মানে শুধু জল নয়—কৃষকের সেচ, জেলের নৌকা, দর্জির নকশিকাঁথা, এমনকি শহরের সকালের পাউরুটিও এই স্রোতে বাঁধা।

আধুনিক সংকট

শিল্পবর্জ্য, অবৈধ জেটি-ইটভাটা আর দখলদারির চাপে রূপসা হারাচ্ছে শ্বাস। পাড় ভরাটে সংকুচিত হচ্ছে প্রশস্ততা, নাব্য কমে মাছের বিচরণক্ষেত্রও ধ্বংস হচ্ছে। যদি নিয়মিত খনন, বর্জ্য শোধনাগার, আর দখলমুক্ত সবুজ তীর নিশ্চিত করা না যায়, তবে নড়াইল–যশোর–খুলনার কৃষি ও মৎস্যনির্ভর জীবিকা গভীর বিপদে পড়বে।

ভবিষ্যতের দিশা

নদীর জন্মগাথা যেমন এক সাহসী ব্যবসায়ীর খাল-কাটা স্বপ্ন, তেমনি ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর। ভৈরব–রূপসা–নবগঙ্গার নৌপথ ধীরে ধীরে খনন করুন, শিল্পবর্জ্য শোধনাগার বাধ্যতামূলক করুন, দখলমুক্ত সবুজ তীর ফিরিয়ে দিন, আর ‘রকেট’ স্টিমারকে ঘুরিয়ে দিন ঐতিহ্যবাহী পর্যটন ক্রুজে।

নদী যদি বাঁচে, বাঁচবে খুলনার হারানো ইতিহাস, বাণিজ্যের সোনালি দিন, আর অগণিত জীববৈচিত্র্য। রূপসার বুকে আবারও উঠবে নতুন জোয়ার—স্বপ্নভরা, সম্ভাবনাময়।

সমুদ্রের ওপার থেকে নতুন স্বপ্ন: তাইওয়ান তরুণদের ফুচিয়ানে নতুন জীবনগাঁথা

রূপসা নদী: এক খাল কাটা স্বপ্ন থেকে দক্ষিণের প্রবেশদ্বার

০২:২৮:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

শুরুর সেই দিনটি

উনিশ শতকের মাঝামাঝি। নড়াইলের লবণ ও কাঠ ব্যবসায়ী রূপচাঁদ সাহা ভাবলেন, ভৈরব দিয়ে কলকাতামুখী পণ্য পাঠাতে বারবার বাঁক নিতে গিয়ে সময় নষ্ট হয় কেন? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজ খরচে কাটবেন একটি ছোট খাল। স্বপ্নটির নাম হয়ে গেল ‘রূপ সাহার খাল’। ভৈরবের স্রোত ও বন্যার খেয়ালে সেই সরু জলপথ দ্রুতই প্রশস্ত হয়ে রূপ নেয় এক পূর্ণাঙ্গ নদীর—আমাদের চেনা রূপসা।

পথরেখা ও চরিত্র

ভৈরব ও মধুমতী মিলে খুলনার পূর্ব প্রান্তে যে বিস্তৃত জলধারা গড়ে তোলে, সেটিই রূপসা। উত্তরে নড়াইলের নবগঙ্গা–কুমার–চিত্রা নদীগুচ্ছ এসে ভৈরবে মিশে জলপথকে আরও প্রশস্ত করে, আর দক্ষিণে রূপসা নেমে পশুর নদীতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে হারিয়ে যায়। এই নদীপথই একসময় যশোর–নড়াইল অঞ্চলের পাট, ধান, মাছ, এমনকি নকশিকাঁথার আড়ত ভরাত খুলনা শহরের ঘাটে।

নদীকেন্দ্রিক খুলনার কোলাহল

একশো বছর আগে—বিশ শতকের তৃতীয় দশকে—খুলনা ছিল শব্দে-গন্ধে এক নদীবন্দরনির্ভর নগরী। রূপসা ঘাটে নোঙর ফেলত পাট ও চামড়া-বোঝাই বড় নৌকা, ‘রকেট’ প্যাডেল স্টিমার, কাঠ-চালিত বার্জ। নদীর ধারেই গড়ে উঠেছিল জুট গুদাম, রেলস্টেশন, আদালত, বাজার আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নদীর ঢেউ যেন তখন শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ত।

নড়াইলযশোর থেকে কলকাতা: বাণিজ্যের সোনালি রুট

চিত্রা–নবগঙ্গা টপকে নড়াইল হাটের পাট-বোঝাই নৌকা রূপসা ধরে খুলনায় আসত। এখান থেকে স্টিমারে চেপে সোজা কলকাতার বাবুগাট বা গুয়ারি ঘাট। ইন্ডিয়া জেনারেল স্টিম ন্যাভিগেশন কোম্পানির ভাটিয়ালি সুরময় হুইসেলেই ছিল ইংরেজ শাসিত ভারতে অন্যতম ব্যস্ত নৌরুটের সিগন্যাল।

সড়করেলের যুগে রূপসা

খান জাহান আলী সেতু (২০০৫) ১.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কসেতু খুলনা–বাগেরহাট মহাসড়কের গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবেশদ্বার তখন থেকেই খুলনা।

রূপসা রেল সেতু (২০২৩) ৫.১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ধাতব পালকে মুকুটখচিত। খুলনা থেকে মংলা বন্দরে এখন পণ্যবোঝাই ট্রেন যায় একটানা, বাণিজ্য-সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয় বহুগুণ।

নদীর সংসার: মাছ ও মানুষ

২০১৬-এর সমীক্ষা বলছে রূপসায় এখনো ৬২টি মাছের প্রজাতির বাস। রুই-কাতলা প্রচুর, ইলিশ-বাঘাইড় নদীর প্রাণ। তবে দূষণ ও নাব্যহ্রাসে অন্তত নয়টি প্রজাতি সংকটে। নদী মানে শুধু জল নয়—কৃষকের সেচ, জেলের নৌকা, দর্জির নকশিকাঁথা, এমনকি শহরের সকালের পাউরুটিও এই স্রোতে বাঁধা।

আধুনিক সংকট

শিল্পবর্জ্য, অবৈধ জেটি-ইটভাটা আর দখলদারির চাপে রূপসা হারাচ্ছে শ্বাস। পাড় ভরাটে সংকুচিত হচ্ছে প্রশস্ততা, নাব্য কমে মাছের বিচরণক্ষেত্রও ধ্বংস হচ্ছে। যদি নিয়মিত খনন, বর্জ্য শোধনাগার, আর দখলমুক্ত সবুজ তীর নিশ্চিত করা না যায়, তবে নড়াইল–যশোর–খুলনার কৃষি ও মৎস্যনির্ভর জীবিকা গভীর বিপদে পড়বে।

ভবিষ্যতের দিশা

নদীর জন্মগাথা যেমন এক সাহসী ব্যবসায়ীর খাল-কাটা স্বপ্ন, তেমনি ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর। ভৈরব–রূপসা–নবগঙ্গার নৌপথ ধীরে ধীরে খনন করুন, শিল্পবর্জ্য শোধনাগার বাধ্যতামূলক করুন, দখলমুক্ত সবুজ তীর ফিরিয়ে দিন, আর ‘রকেট’ স্টিমারকে ঘুরিয়ে দিন ঐতিহ্যবাহী পর্যটন ক্রুজে।

নদী যদি বাঁচে, বাঁচবে খুলনার হারানো ইতিহাস, বাণিজ্যের সোনালি দিন, আর অগণিত জীববৈচিত্র্য। রূপসার বুকে আবারও উঠবে নতুন জোয়ার—স্বপ্নভরা, সম্ভাবনাময়।