সকালেই বোঝা মিলল সপ্তাহের ধাক্কা
শুক্রবার কারওয়ান বাজার, পালাশি, শান্তিনগর, হাতিরপুল ও মোহাম্মদপুরের কিচেন মার্কেট ঘুরে দেখা গেল—দামের সিঁড়ি আরও একধাপ উঁচু হয়েছে। বৃষ্টির ভেজা রাস্তা মাড়িয়ে ছুঁয়ে-ফেলা বাজারে ক্রেতাদের মুখে ছিল একটাই প্রশ্ন, “কিছুই কি আর আগের দামে পাওয়া যাবে না?” বাজার শেষে অনেকে প্রয়োজনীয় পণ্যের অর্ধেকই না কিনে ঘরে ফেরেন।
চালের কেজিতে আরও ৩-৬ টাকা
কারওয়ান বাজারের আড়তের হিসাবে মিনিকেট এখন ৭৬-৮৬ টাকা কেজি; এক সপ্তাহ আগেও যা ছিল ৭২-৮০ টাকা। মাঝারি মানের পাজাম ও আতপ-আথাশ বেড়ে ৫৬-৬৫ টাকায় দৌড়াচ্ছে। মোটা চালও ৫৫-৬০ টাকার নিচে নামছে না। আড়তদাররা বলছেন, উৎপাদন এলাকায় ধানের দাম বেড়ে যাওয়াই এর মূল কারণ, সঙ্গে ভারী বৃষ্টিতে ভেজা পাকা ধান নষ্ট হওয়ার শঙ্কা।
সবজির থলে ভারী, কিন্তু পকেট হালকা
শুক্রবার পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা কেজিতে, দেশি রসুন ১৩০ ও আমদানি-নির্ভর রসুন ২০০ টাকায়। সাপলাউ ও ঢেঁড়স ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, স্পাইনি গার্ড পর্যন্ত ৬০ টাকা ছাড়া নামছে না। বরবটি, করলা, বেগুনের দাম ৫০-৬০ থেকে এক লাফে ৮০ টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সবজি বিক্রেতা মো. জাকির হোসেনের ভাষায়, “মৌসুম পার হয়ে গেছে, বৃষ্টিতে ক্ষেতও নষ্ট—সরবরাহই যখন কম, দাম কেন কমবে?”
মাছের হাঁড়িতে ‘স্বস্তি’ নেই, দামই স্থিতিশীল!
ট্রলারের জাল উঠছে কম, আর ঢাকার বাজারে মাছের গন্ধ পাচ্ছেনও কম—তবু দাম কমেনি। শুক্রবার রুই-কাতলা প্রজাতি আকারভেদে ৩০০-৪৫০ টাকা কেজি, পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া ২০০-২২০, শিং ৩৫০-৫০০, কই ২৩০-২৫০, আর গলদা-বাগদা চিংড়ি ছোট-বড় মিলে ৬৫০-১,২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বড় আকারের ইলিশের দাম ১,৬০০-২,০০০ টাকার নিচে নামেনি। বিক্রেতারা জানালেন, আগের সপ্তাহের তুলনায় প্রতি কেজিতে গড়ে ২০-৩০ টাকা বাড়তি গুনছেন ক্রেতারা।
গৃহিণী সাবেরা নাহার ক্ষোভ চাপলেন, “ইলিশ তো বিলাস, রুই-কাতলাও এখন স্বপ্ন! শাক-সবজি দিয়ে ভাত সারতেই মাসের বাজেট উল্টে যাচ্ছে।”
‘দাম বাড়ার তিন কারণ’—বিক্রেতা-বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা
বৃষ্টি আর রাস্তায় জলাবদ্ধতা—পচনশীল পণ্য ঢাকায় আনতে দেরি, নষ্টের ঝুঁকি সামাল দিতেই অতিরিক্ত দাম।
ধান-মজুদ সিন্ডিকেট—কিছু মিলার বেশি দামে বিক্রির আশায় ধান তুলে রাখায় পাইকারি পর্যায়ে টানাটানি।
মাছের সরবরাহ সংকট—বর্ষা, নদী-উথাল আর জেলেদের অনিয়মিত জাল ফেলা মিলিয়ে মাছের জোগান কম।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারুক হোসেন মনে করেন, উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে “মধ্যস্বত্বভোগী-নির্ভরতা” কমানো না গেলে দামের এই দোলাচল চলতেই থাকবে।
পরিবারের হেঁশেলে কি পড়ছে এর প্রভাব?
মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্মজীবী বাসিন্দা রিনা আক্তার হিসাব দেন, “মাস গেলে শুধু চাল-ডাল-সবজি-মাছেই অতিরিক্ত হাজার টাকা উধাও হচ্ছে। বাচ্চাদের দুধ-ডিম কমিয়ে একরকম টিকে আছি।” পুষ্টিবিদরা সতর্ক করছেন, মাছ আর সবজি হাতের বাইরে চলে গেলে শিশু-বয়স্ক সবারই প্রোটিন-মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের ঘাটতি বাড়বে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে কী করা জরুরি
- সরকারি নজরদারি বাড়ানো—পাইকারি আড়ত ও মিল-এলাকায় যৌথ টাস্কফোর্সের তৎপরতা।
- টিসিবি ট্রাকসেল সম্প্রসারণ—কম আয়ের মানুষের জন্য নির্দিষ্ট দিনে চাল-ডাল-তেল-মাছ স্বল্পদামে বিক্রি।
- ‘সবুজ করিডর’ চালু—পচনশীল পণ্যবাহী ট্রাকে আলাদা রুট ও টোল-মওকুফ, যাতে সরবরাহে দেরি না হয়।