বাংলাদেশে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নরসুন্দর পিতা ও পুত্রকে মারধর করে পুলিশে দেয়া হয়৷ অভিযুক্তের পরিবারের দাবি, ধর্ম অবমাননার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ সংশ্লিষ্ট থানার ওসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
লালমনিরহাটের পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলের পেশা মানুষের চুল কাটা৷ ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ‘উত্তেজিত জনতা’ পিটিয়ে তাদের পুলিশে দেয়৷ প্রকাশ্যে অভিযুক্তদের ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ফাঁসি নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)৷
ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পিটিয়ে পুলিশে দেয়া বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়৷ সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে সাড়া জাগানো দুটি ঘটনার একটি খুলনার৷ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সেই ঘটনায় উৎসব মণ্ডল নামের ১৬ বছর বয়সি এক কিশোরকে তিন বাহিনীর উপস্থিতিতেই পেটানো হয়৷ পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে – এমন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে জানানো হয় উৎসব বেঁচে আছে৷
পরের ঘটনাটি ২০২৪ সালের অক্টোবরের৷ ফরিদপুরে সেই ঘটনার শিকার হৃদয় পাল৷ একই ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য দ্বিতীয়বার ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হলে এক পর্যায়ে সেনা হেফাজতে নিতে হয় তাকে৷ স্ট্যাটাসটি সম্পর্কে স্থানীয় সাংবাদিক কাজী আল আমীন ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, “যে আইডি থেকে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে, সেই আইডির নাম কৃষ্ণা দাস রাহুল। আর ওই ছেলের নাম হৃদয় পাল। আমি এটা নিয়ে পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি যে, কৃষ্ণা দাস রাহুল নামে ফেসবুক আইডি সে চালায় কিনা। আমাকে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেনি যে ওই আইডি তার।”
তবে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি তদন্ত শুরুর আগেই অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করার আশ্বাস দিচ্ছেন – এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি৷ লালমনিরহাটে পুলিশের এমন প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা দুই ধর্মীয় সংখ্যালঘু নরসুন্দরের সুবিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে শঙ্কার মুখে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা৷
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে পিটিয়ে পুলিশে দেয়ার ঘটনাটি ঘটে গত ২২ জুন৷ পুরো ঘটনাটি ঘটে স্থানীয় এক ইমামের নেতৃত্বে৷ ‘উত্তেজিত জনতা’র উদ্দেশ্যে লালমনিরহাট সদর থানার ওসি বলেন, “এমন মামলা তাদের দেবো, নিশ্চিত তাদের যেন যাবজ্জীবন বা ফাঁসি হয়৷” ওসির এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনদের অনেকেই সমালোচনামুখর হন৷ মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন এমন বক্তব্যের কারণে সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন।
পিটিয়ে পুলিশে দেয়ার সময় প্রবীণ পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণুে চন্দ্র শীল দাবি করেন, ধর্ম অবমাননার অভিযোগটি সত্য নয়৷ তারা এখন কারাগারে৷ তবে বিষ্ণু চন্দ্র শীলের স্ত্রী দীপ্তি রানী শীলেরও দাবি, “ ধর্ম অবমানার কোনো ঘটনা ঘটেনি। চুল কাটিয়ে এক তরুণ ১০ টাকা কম দিতে চাওয়ায় বাকবিতন্ডার জেরে ধর্ম অবমাননার (অভিযোগ তুলে) হামলা চালানো হয়েছে।”
বুধবার, অর্থাৎ ঘটনার দু দিন পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওই এলাকা পরিদর্শন করেন। সমাবেশ করে সবার প্রতি শান্তি বজায় রেখে যার যার ধর্ম পালনের আহ্বানও জানান তারা।
দীপ্তি রানীও সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেখানে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, “আমার স্বামী, শ্বশুর কোনো অপরাধ করেননি। তারা ধর্ম অবমাননা করেননি। তাদের মুক্তি দিন।”
লালমনিরহাট সদর উপজেলায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়
২২ জুন দুপুরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে স্থানীয় ‘গোলাসা বাজার জামে মসজিদের সম্মিলিত মুসুল্লিবৃন্দের’ ব্যানারে মিছিল বের করা হয়।জোহরের নামাজের পর বের করা মিছিলটি লালমনিরহাট শহরের হানিফ পাগলার মোড়ে পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলের সেলুনে যায়। কিছু লোক সেলুন থেকে প্রবীণ নরসুন্দর ও তার ছেলেকে টেনে বের করে। দোকানের সামনেই তাদের মারধর করা হয়। মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷ ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু লোক ৬৯ বছর বয়সি পরেশ চন্দ্র শীল ও তার ৩৫ বছর বয়সি সন্তান বিষ্ণু চন্দ্র শীলকে মারধর করছে। পরেশ চন্দ্র শীলকে মারতে
মারতে ঘাড়ধাক্কা দেয়া হচ্ছে। বিষ্ণু বারবার হাত জোড় করে বাবাকে ছেড়ে দিতে বললেও তাতে কাজ হয়নি৷ পরেশ চন্দ্র শীলের, “আমি বলি নাই, আমি বলি নাই-” দাবিতে কান না দিয়ে ‘গোলাসা বাজার জামে মসজিদের সম্মিলিত মুসুল্লি’দের কয়েকজন তখন মারপিট চালিয়ে যান৷
এক পর্যায়ে পুলিশ ডাকা হয়৷ পুলিশ এলে তাদের সামনেও চলে মারধর৷ তারপর পিতা-পুত্রকে তুলে দেয়া হয় পুলিশের হাতে৷
পুলিশের সঙ্গে পরেশ ও বিষ্ণু থানায় গেলে থানার সামনেও ভিড় জমে৷ থানা চত্তরেই চলতে থাকে উত্তেজিত জনতার স্লোগান৷
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে থানায় অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। উপস্থিত উত্তেজিত জনতাকে তখনই ‘আশ্বাসবাণী’ শোনান সদর থানার ওসি নুরনবী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বক্তব্যের ভিডিও-ও ছড়িয়ে পড়ে৷ ভিডিওতে ওসি নুরনবীকে বলতে শোনা যায়, ‘‘ওসি হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমার। কিন্তু যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমারও কলিজায় আগুন লেগেছে। আপনাদের মতো চোখে পানি আমারও এসেছে। কীভাবে এত বড় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এ দেশে করে। আমি আপনাদের ওয়াদা দিলাম, আমি তাদের যখন অ্যারেস্ট করেছি, বাংলাদেশে এমন মামলা তাদের দেবো, নিশ্চিত তাদের যেন যাবজ্জীবন বা ফাঁসি হয়…।’’
তিনি আরো বলেন, “উত্তেজিত জনতা তাদের ঘেরাও করলে তারা মাফ চায় আর ধর্ম অবমননার কথা অস্বীকার করে। সেই কারণে কয়েকটি গলাধাক্কা দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। অস্বীকার করলেও আমি তার আগের আচরণ জানি। তারা আমার পরিচিত। আগেও তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে।”
“তবে আমিও অবমাননার ঘটনার সময় ওই সেলুনে ছিলাম না। নাজমুল অনেককে বলেছেন। আমি স্থানীয় জনতার কাছে শুনেছি যে, সে নবীকে অবমাননা করেছে।”
তিনি জানান, এখনো পরিবারের পক্ষ থেকে পরেশ চন্দ্র শীল ও বিষ্ণু চন্দ্র শীলের জামিনের আবেদন করা হয়নি। আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার মো. তরিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে জানা যাবে ধর্ম অবমাননা হয়েছে কি হয় নাই। তাদের পরিবার ১০ টাকার বিষয় নিয়ে যে দাবি করছে, তারও তদন্ত হবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধর্ম অবমাননার বিষয়টি এসেছে।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেেকে বলেন, “মানুষের বিরুদ্ধে যে অভিযোগই থাকুক না কেন সেটা আদালত দেখবে, আদালত বিচার করবে। কিন্তু মব-সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিচার করা, পুলিশে দেয়া -এটা আইনবিরোধী। যারা মব তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ এখনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু ওসি সাহেব যে কথা বলেছেন তা মবকে আরো উৎসাহিত করেছে। এতে সমাজে অনাস্থা তৈরি হয়।”