রাজীব আহমেদ (ছদ্মনাম) দেশের একটি খ্যাতনামা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি শেষ করেছেন পাঁচ বছর আগে। প্রথম দিকে পরিবারের সবাই খুব আশাবাদী ছিলেন—ছেলেটা সরকারি চাকরি পাবে, শিক্ষকতা করবে, বা অন্তত কোনও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতন পাবে। কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেছে, রাজীব আজও বেকার।
প্রথম বছরটা কাটল পরীক্ষা-প্রতিযোগিতা দেওয়া আর প্রস্তুতি নেওয়ায়। বিসিএস, ব্যাংক নিয়োগ, এনজিও নিয়োগ—যা পেতেন তাই দিতেন। কয়েকবার ভাইভা পর্যন্ত গিয়েও চাকরি হয়নি। সরকারি চাকরির কোটা ও সীমিত পদের কারণে প্রথমেই হতাশা এসেছে। বেসরকারি চাকরিতেও অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, বেতন খুব কম দেওয়া হয়, আবার সুপারিশ ছাড়াও সুযোগ মেলে না।
অভিজ্ঞতা না থাকা, পরিচয় না থাকা আর নিয়োগ বাণিজ্য—এই বাস্তবতা তাঁকে ভীষণ ক্লান্ত করেছে। দ্বিতীয় বছরে কোচিং সেন্টারে গিয়ে কিছু টাকা উপার্জনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেটি টিকে থাকেনি—কোভিড পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায়। এরপর বন্ধুরা অনেকে বিদেশে চলে গেছে বা ঢাকায় ভালো বেতনের চাকরিতে ঢুকে গেছে। তিনি গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
গ্রামে ফিরে যাওয়ায় সামাজিক জীবনে এসেছে অন্যরকম লজ্জা আর বিচ্ছিন্নতা। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা শুরুতে সহানুভূতিশীল ছিলেন, পরে ব্যঙ্গ, রসিকতা, সন্দেহ—সবই এসেছে। “এত পড়াশোনা করে কি লাভ?” “মাস্টার্স পাশ ছেলে কৃষিকাজ করে কেন?”—এ ধরনের মন্তব্য শুনতে হয়েছে প্রায়ই। পরিবারও আর তেমন উৎসাহ দিতে পারছে না, কারণ তাদেরও চলার খরচ জুগানো কষ্টকর।
অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়েছে। বাবার সামান্য পেনশন আর ছোট ভাইয়ের কাজের টাকায় সংসার চলে। নিজের জন্য পোশাক বা বই কেনার কথা ভাবতে পারেন না। বিয়ের কথাবার্তাও থেমে গেছে—কনে পক্ষ সরাসরি বলে দেয় “কাজ নেই ছেলের, বিয়ে হবে কীভাবে?” বন্ধুরা দূরে সরে গেছে, সামাজিক অনুষ্ঠানেও ডাক কমে গেছে।
আজ রাজীব মাঝেমধ্যে গ্রামের বাজারে কৃষিপণ্য বিক্রি করেন। ছোটদের টিউশন করেন, তবে মাসে ১৫০০ – ২০০০ টাকার বেশি ওঠে না। তিনি বলেন—“এখন নিজের পড়াশোনাই বোঝা হয়ে গেছে। চাকরি নেই মানে সম্মান নেই, উপার্জন নেই মানে সম্পর্ক নেই। কেউ পাশে নেই।”
রাজীবের এই গল্প দেশের হাজার হাজার শিক্ষিত বেকারের কষ্টের প্রতিচ্ছবি। শিক্ষা নিলেও কাজ নেই—কারণ শিল্প নেই, বিনিয়োগ নেই, দক্ষতা-চাহিদার মিল নেই, এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা। অথচ এই মানুষগুলোই হতে পারত দেশের উন্নয়নের চালিকাশক্তি। সমাজ তাদের প্রতিভা ও শ্রমকে কাজে লাগাতে পারছে না।
রাজীবের স্বপ্ন ভেঙে গেছে—কিন্তু তিনি পুরোপুরি হাল ছাড়েননি। “যদি কখনো কিছু ছোট ব্যবসা করতে পারি, বা অনলাইন কিছু শিখে ফ্রিল্যান্স করতে পারি, তাহলে চেষ্টা করবো,” বলেন তিনি। তবু পাঁচ বছরের বেকার জীবনের ক্ষত তাকে গভীর হতাশায় ঠেলে দিয়েছে—যেখানে সম্মান, স্বপ্ন, সম্পর্ক—সবই প্রশ্নের মুখে।
এ গল্প শুধু রাজীবের নয়—এটি আমাদের সমাজের ব্যর্থতার গল্প। রাষ্ট্র ও সমাজ যদি এই শিক্ষিত, পরিশ্রমী, কিন্তু হতাশ হয়ে পড়া মানুষগুলোর পাশে না দাঁড়ায়, তবে আমরা শুধু ব্যক্তিগত নয়, জাতীয় সম্পদও হারাব।