টোকিও ভ্রমণে অক্টোপাস: এক ব্যতিক্রমী শিল্পচর্চা
জাপানি শিল্পী শিমাবুকু একবার একটি জীবন্ত অক্টোপাসকে সঙ্গে নিয়ে টোকিও শহর ঘুরিয়েছিলেন। বয়স তখন তার ৩১ বছর। জাপানের আকাশি শহরের উপকূল থেকে স্থানীয় এক জেলের সাহায্যে অক্টোপাসটি ধরে তিনি ট্রেনে করে তিন ঘণ্টার বেশি সময় নিয়ে সেটিকে একটি বিশেষ ঠাণ্ডা পানির ট্যাংকে রেখে টোকিওতে নিয়ে যান। সেই একই দিন তিনি আবার প্রাণীটিকে তার সমুদ্রে ফেরতও পাঠান।
শিমাবুকু বলেন, “আমি ২০ বছর বয়স থেকে ভ্রমণ শুরু করি। কিন্তু অক্টোপাসদের তো এমন অভিজ্ঞতা হয় না। আর যদি কোথাও যায়ও, সাধারণত সেটি খাওয়ার জন্যই ধরা পড়ে। আমি চেয়েছিলাম অক্টোপাসকে ভ্রমণে নিতে, কিন্তু সেটা খাওয়ার জন্য নয়।”
অক্টোপাসের প্রতিক্রিয়া এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সংযোগ
ভিডিওতে ধারণ করা সেই ভ্রমণে দেখা যায়, অক্টোপাসকে নিয়ে শিমাবুকু টোকিও টাওয়ার এবং পরবর্তীতে বিখ্যাত সুকিজি মাছ বাজারে যান। সেখানে অক্টোপাসটি দোকানে রাখা অন্যান্য অক্টোপাস দেখেই শক্ত প্রতিক্রিয়া জানায়। শিমাবুকুর ভাষায়, “অক্টোপাস বুদ্ধিমান প্রাণী — হয়তো সে ফিরে গিয়ে তার সাগরের বন্ধুদের এসব অভিজ্ঞতা বলেছে।”
এই ব্যতিক্রমী ভ্রমণ থেকেই শুরু হয় শিমাবুকুর একাধিক শিল্পপ্রয়াস, যেখানে তিনি অক্টোপাসদের সঙ্গে একধরনের বন্ধুত্ব ও রসিকতা মিলিয়ে কাজ করেন। বর্তমানে তার এই প্রকল্পগুলোর অংশ দুটি প্রদর্শনীতে যুক্তরাজ্যে প্রদর্শিত হচ্ছে: লন্ডনের ডিজাইন মিউজিয়ামে “More than Human” (চলবে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত) এবং নরউইচের সাইন্সবেরি সেন্টারে “Sea Inside” (চলবে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত)।
অক্টোপাসের শখ, সংগ্রহ এবং রুচি
শিমাবুকু অক্টোপাসের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসেন — কী তাদের পছন্দ, অনুভব কিংবা কৌতূহল জাগে কিনা। তার মতে, “অনেক প্রাণীর জীবনে খাওয়া আর প্রজননই মুখ্য। কিন্তু অক্টোপাসদের হয়তো সময় আছে ঘোরাঘুরি বা শখের জন্য।”
কোবেতে বসবাসকালে তিনি স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরতে যেতেন, এবং তখন জানতে পারেন, কিভাবে মাটির কলসিতে অক্টোপাস ধরা হয়। সাগরে শত শত খালি কলসি ফেলা হয়, আর কয়েকদিন পর তোলা হলে দেখা যায় অনেক অক্টোপাস ভেতরে ঢুকে আছে — তারা ছোট ও সঙ্কীর্ণ জায়গা পছন্দ করে।
অক্টোপাসের জন্য ভাস্কর্য তৈরি
শিমাবুকু লক্ষ্য করেন, কলসির ভেতর অক্টোপাসরা নানা কিছু বহন করছে — শামুকের খোলস, পাথর, এমনকি ভাঙা বিয়ার বোতলের টুকরো পর্যন্ত। তিনি এসব ছোট বস্তু জমান, একে বলেন “সংগ্রহের সংগ্রহ”।
এ থেকেই তার মাথায় আসে অক্টোপাসের জন্য ভাস্কর্য তৈরির ভাবনা। ২০১০ সালে “Sculpture for Octopuses: Exploring for Their Favorite Colors” নামের প্রকল্পে তিনি নানা রঙের কাচের বল ও পাত্র তৈরি করেন। প্রথমে সাগরে সেগুলো ফেলে দেন উপহার হিসেবে, এরপর জানতে চান অক্টোপাস কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
কোবের সুমা অ্যাকোয়ালাইফ পার্কের সহায়তায় তিনি একটি বড় পানির ট্যাংকে এসব বস্তু দিয়ে প্রতিক্রিয়া ধারণ করেন। দেখা যায়, অক্টোপাসরা সেগুলো নিয়ে খেলে, ঘুরায়, এমনকি তাদের শুঁড় দিয়ে ধরে রাখে।
শিমাবুকুর ভাষায়, “তারা হয়তো বেশি হাত থাকার কারণে কিছু না কিছু ধরতেই চায়। তাই স্পর্শ করতে থাকে।”
স্পেনে একক প্রদর্শনী ও সমুদ্রের নিচে পর্যবেক্ষণ
২০২৪ সালে স্পেনের সান্তান্দারে সেন্ট্রো বোটিন গ্যালারিতে তার একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি নিজে তৈরি ও পুরনো দোকান কিংবা ই-বে থেকে কেনা কাচ ও মাটির পাত্র সমুদ্রের তলদেশে ফেলেন এবং ডুব দিয়ে ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করেন অক্টোপাসের প্রতিক্রিয়া। প্রত্যাশামতো, অনেক অক্টোপাস সেগুলোর ভেতরে ঢুকে পড়ে।
যদিও অক্টোপাস রঙ চেনার ক্ষমতা রাখে না, শিমাবুকু দেখতে চেয়েছেন কোন রঙ বা বস্তু তাদের বেশি আকর্ষণ করে। “জেলেরা বলেন, তারা লাল রঙ পছন্দ করে। কোবেতে একবার লাল পাত্রে একটি অক্টোপাস পেয়েছিলাম — সেদিক থেকে আমার বিশ্বাস।” তবে তিনি আরও বলেন, অক্টোপাস মসৃণ ও চকচকে কাচের বস্তু বেশি পছন্দ করে বলে মনে হয়।
বিজ্ঞান নয়, বন্ধুত্বই লক্ষ্য
এই সব প্রকল্প কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা নয়, বরং একজন শিল্পীর পক্ষ থেকে আট পা-ওয়ালা রহস্যময় প্রাণীর প্রতি গভীর টান ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার এক সৃজনশীল প্রয়াস। শিমাবুকু এই প্রাণীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাদের সঙ্গে “শিল্পের সংলাপ” গড়ে তুলতেই আনন্দ পান।