“আবারও থামতে হবে?” গাড়ি করে ঘুরতে গেলে এই অভিযোগ খুব সাধারণ এবং এই প্রশ্নটি বেশিরভাগ সময় কেবল নারীদের উদ্দেশ করেই বলা হয়।
এমনকি টিভি কমেডি থেকে শুরু করে স্ট্যান্ডআপ কমেডিতেও ঠাট্টা করে বলা হয়, মেয়েদের মূত্রথলি বুঝি খুবই ছোট।
কিন্তু শারীরবৃত্তীয়ভাবে এই ধারণা কতটা সঠিক?
সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, বিষয়টি এমন না। এই ব্যাপারটি মূলত শারীরবিদ্যা, শারীরিক কার্যপ্রক্রিয়া ও সামাজিক আচরণের এক জটিল বন্ধন।
নারীরা ঘনঘন বাথরুমে যাওয়ার তাগিদ বা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারে ঠিকই। কিন্তু নারী আর পুরুষের মূত্রথলির আকারে প্রকৃত অর্থে খুব বেশি তফাৎ নেই।
আমাদের মূত্রথলি অনেকটা পেশিবহুল ফোলানো বেলুনের মতো, যা প্রসারিত হতে পারে। এর দু’টো গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে। এক, ডিট্রুজার মাসল। দুই, ট্রানজিশনাল এপিথেলিয়াম।
ডিট্রুজার হলো মূত্রথলির দেয়ালে থাকা মসৃণ পেশি। এর বিশেষ এক ইলাস্টিক ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ, এটি অনেক বেশি সম্প্রসারিত হতে পারে। তাই, থলিতে মূত্র জমে গেলেও এটি সহজে মস্তিষ্কে এই সংকেত দেয় না যে “থলি ভর্তি” হয়ে গেছে।
যখন থলিতে অনেক বেশি মূত্র জমে যায়, তখন মাসল সংকুচিত হয়ে মূত্র বের করে দেয়।
মূত্রথলির ভেতরে যে আস্তরণ থাকে, তার নাম ট্রানজিশনাল এপিথেলিয়াম, যা অনেকটা ভাঁজের মতো। মূত্র জমা হলে এটি নিজের আকৃতি বদলায়। কখনো প্রসারিত হয়, কখনো লম্বা হয়ে যায়, যাতে করে মূত্রথলি বেশি করতে প্রস্রাব ধরতে পারে।
এই আস্তরণটি আবার প্রস্রাবে থাকা বিষাক্ত উপাদান থেকে ভেতরের টিস্যুগুলোকে রক্ষা করে।
মূত্রথলির এই ডিজাইনের জন্য মূত্রথলি কোনো প্রকার না ফেটে বা ঢিলেঢালা না হয়ে এবং অহেতুক প্রস্রাবের চাপ অনুভব না করিয়ে জীবনভর প্রসারিত ও সংকুচিত হতে পারে।
পুরুষরা সহজেই বারবার প্রস্রাব করতে পারে
নারী ও পুরুষের মূত্রথলির মধ্যে পার্থক্য কী
গাঠনিকভাবে পুরুষ ও নারীর মূত্রথলির মাঝে ভিন্নতার চেয়ে মিল-ই বেশি। উভয়েরই মূত্রথলি অনায়াসে ৪০০ থেকে ৬০০ মিলিলিটার প্রস্রাব ধারণ করতে পারে।
তবে মূত্রথলির চারপাশে যেসব অঙ্গ থাকে, তা প্রস্রাব লাগার অনুভূতিতে পার্থক্য তৈরি করে। আর এখান থেকেই নারী ও পুরুষের মূত্রথলির পার্থক্যের শুরু।
পুরুষদের ক্ষেত্রে মূত্রথলি প্রোস্টেটের ওপরে এবং রেকটামের (মলদ্বারের) সামনে থাকে।
অন্যদিকে, নারীদের ক্ষেত্রে এটি একটি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ পেলভিক অঞ্চলে থাকে। সেখানে সে জরায়ু ও যোনির সাথে স্থান ভাগাভাগি করে নেয়।
নারীদের গর্ভাবস্থায় বড় হতে থাকা জরায়ু মূত্রথলিকে চেপে ধরে। এই কারণেই শেষ ত্রৈমাসিকে নারীদের প্রায় প্রতি ২০ মিনিট পরপর বাথরুমে যেতে হয়।
যদি গর্ভাবস্থা না-ও থাকে, তারপরও স্থান স্বল্পতার কারণে মূত্রথলিতে তুলনামূলক সামান্য পরিমাণ প্রস্রাব জমলেই নারীরা প্রস্রাবের ‘প্রেসার’ বা ‘বেগ’ অনুভব করাতে পারে।
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা তুলনামূলকভাবে কম প্রস্রাব জমলেই ‘পূর্ণ ব্লাডার’ বা মূত্রথলি ভর্তি হওয়ার অনুভব পেতে পারেন। এর কারণ হতে পারে হরমোনের প্রভাব, সংবেদনশীলতার তারতম্য বা পেলভিক ফ্লোর ও ব্লাডারের প্রসারণের মধ্যকার জটিল সম্পর্ক।
পেলভিক ফ্লোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশিগুচ্ছ যা মূত্রথলি, জরায়ু ও অন্ত্রকে সমর্থন দেয়।
নারীদের ক্ষেত্রে প্রসব, হরমোন পরিবর্তন বা বয়সের সাথে সাথে এই পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যেতে পারে। তখন নারীদের মূত্রথলির ‘ধরে রাখা’ ও ‘ছাড়ার’ মধ্যকার নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
এই নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই নির্ভর করে “এক্সটারনাল ইউরেথ্রাল স্পিঙ্কটার” নামক পেশির ওপর, যা মূত্রনালীর শেষপ্রান্তে একটি ‘গেটকিপার’ বা দ্বাররক্ষীর মতো ভূমিকা পালন করে।
এই পেশিটিই সামাজিকভাবে উপযুক্ত সময় পর্যন্ত প্রস্রাব আটকে রাখতে সাহায্য করে।
এই স্পিঙ্কটার নামের পেশিটি পেলভিক ফ্লোরের অংশ এবং অন্যান্য পেশির মতোই এটি তার শক্তি হারাতে পারে বা নতুনভাবে এটিকে প্রশিক্ষিতও করা যেতে পারে।
এছাড়া, নারীদের ক্ষেত্রে মূত্রনালী ছোট হওয়ায় ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই-এর ঝুঁকি বেশি থাকে। এই সংক্রমণ মূত্রথলিকে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল করে তুলতে পারে, যার ফলে সংক্রমণ সেরে গেলেও বারবার প্রস্রাবের অনুভূতি হতে পারে।
গর্ভাবস্থার শেষ ত্রৈমাসিকে নারীদের ঘন ঘন বাথরুমে যেতে হয়
‘আগে ভাগে’ যাও
বাথরুমের অভ্যাস সংস্কৃতি অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই অনেক মেয়েকেই শেখানো হয়, ‘আগেই বাথরুমে যাও’ বা, পাবলিক টয়লেট এড়িয়ে চলো।
দীর্ঘদিনের এই অভ্যাসের ফলে তারা প্রয়োজনের আগেই প্রস্রাব করে ফেলতে শেখে, যার কারণে তাদের ব্লাডার বা মূত্রথলি পুরোপুরি প্রসারিত হওয়ার সুযোগ পায় না।
পুরুষদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদের অপেক্ষা করতে বা ধৈর্য ধরতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
আর, যারা কখনো সন্তর্পণে পাবলিক টয়লেটের সিট ব্যবহার করেছেন, তারা জানেন যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে দুশ্চিন্তা আমাদের আচরণে ঠিক কতখানি প্রভাব ফেলে।
এদিকে, মূত্রথলি বা ব্লাডারের আকার পরিবর্তন করা না গেলেও, এর সহ্যক্ষমতা বাড়ানো যায়।
এই পদ্ধতিকে বলে মূত্রথলি প্রশিক্ষণ। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইসএস) ও ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনস এই প্রশিক্ষণকে উৎসাহ দেয়।
এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ধাপে ধাপে বাথরুমে যাওয়ার সময়ের ব্যবধান বাড়ানো হয়।
এর ফলে মস্তিষ্ক ও মূত্রথলির মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগ আবার গড়ে ওঠে। এতে একদিকে যেমন মূত্রথলির ধারণক্ষমতা বাড়ে, অপরদিকে প্রস্রাব করার তাগিদও কমে যায়।
এই পদ্ধতির সঙ্গে পেলভিক ফ্লোর এক্সারসাইজ যুক্ত করলে আরও কার্যকর হয়। বিশেষ করে, যাদের হঠাৎ হাঁচি-কাশিতে বা চাপে প্রস্রাব বেরিয়ে যাওয়ার সমস্যা আছে, তাদের জন্য এটি একটি সহজ ও অস্ত্রোপচারবিহীন সমাধান।
অর্থাৎ, মহিলাদের মূত্রথলি আকারের দিক থেকে ছোট না হলেও শারীরিক গঠন এবং সামাজিক কারণে তাদের টয়লেট ব্যবহারে একটু বেশি অসুবিধা হয়।
তাই, কেউ যদি টয়লেটে যাওয়ার কথা শুনে বিরক্ত হয়, তাকে বোঝান যে এটি কোনো ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতা বা ছোট মূত্রথলির ব্যাপার না। এটি শরীরের গঠন, অভ্যাস আর হরমোনের প্রভাব।
দ্য কনভারসেশন