০১:৩৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

ডেঙ্গু মহামারিতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ: কেন পিছু হটছে সরকার?

২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ইতোমধ্যেই ২০ হাজারের বেশি মানুষ। সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে ৭৯‑এ। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর, জেলা‑উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন নতুন রোগী। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতেও প্রশ্ন উঠছে—সরকার কেন দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না?

ডেঙ্গুর বিস্তার: শহর থেকে গ্রাম

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি সেন্টারের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী,সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী রাজধানী ঢাকা শহরে। তবে এবার বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো—ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কক্সবাজারসহ অন্যান্য জেলাতেও ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এমনকি পার্বত্য জেলাতেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, “ডেঙ্গুর এমন বিস্তার গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবার পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ রোগ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না।”

হিটস্ট্রোকে ১৫ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সরকারের ব্যর্থতা: কেন প্রতিরোধ কার্যক্রম ব্যাহত

স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সমন্বয়হীনতা ডেঙ্গু প্রতিরোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধনে যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোক দেখানো এবং দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত। মশা নিধনের জন্য যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বহুক্ষেত্রেই কার্যকর নয় বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকরা।

সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে কোম্পানি থেকে মশার ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে, তাদের কার্যকারিতা পরীক্ষার কোনো মানদণ্ড মানা হয়নি। ফলে, মশা নিধনে এসব ওষুধ কোনো কাজ করছে না।

ব্যর্থ সচেতনতামূলক কার্যক্রম

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও খুব সীমিত। জনবহুল এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে কীভাবে পানি জমা বন্ধ রাখতে হবে, কীভাবে ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে—এ নিয়ে কোনো কার্যকর প্রচারণা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, বাসাবাড়ি বা হাসপাতাল—কোথাও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ বা তদারকি নেই।

একজন সচেতন নাগরিক বলেন, “প্রতিবছর বর্ষা এলেই ডেঙ্গু হয়—এটা এখন পুরনো খবর। কিন্তু সরকার যেন প্রতিবছর নতুন করে চমকে ওঠে। কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।”

স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রস্তুতি

ঢাকার বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েই চলেছে। কোথাও বেড পাওয়া যাচ্ছে না, কোথাও প্রয়োজনীয় প্লেটলেট কিট, ওষুধ বা পরীক্ষা‑নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে ভর্তি না নিয়েই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সের অভাবও এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। জেলা হাসপাতালগুলোতে প্লেটলেট কাউন্ট মেশিন নেই, রক্ত সরবরাহ সীমিত এবং জরুরি ব্যবস্থা একেবারে নাজুক।

আক্রান্তদের দুর্ভোগ: একটি বাস্তব চিত্র

নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আরিফা সুলতানা তাঁর আট বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি জানান, “জেলায় হাসপাতালে কোনো সেবা পাইনি, রক্ত পরীক্ষাও হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে। তাও বেড পাচ্ছি না।”

এই ধরনের অভিজ্ঞতা শুধু তাঁর একার নয়। প্রতিদিন শত শত মানুষ দূর‑দূরান্ত থেকে ঢাকায় এসে চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: সামনে আরও ভয়াবহ হতে পারে

স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্ষার বাকি সময়ে যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগস্ট‑সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বাড়তে পারে। তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সমন্বিত অভিযান এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, “এই মুহূর্তে দরকার ব্যাপক হারে হটস্পট এলাকায় মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ, সক্রিয় তদারকি এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। অন্যথায় হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ আর নেওয়ার মতো থাকবে না।”

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন মৌসুমি সমস্যা নয়; বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সংকট। এর সমাধান এককভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশন দিয়ে সম্ভব নয়। চাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর সমন্বয়, আধুনিক ওষুধ, প্রশিক্ষিত জনবল এবং জনসম্পৃক্ত সচেতনতা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার যদি এখনই সজাগ না হয়, তবে সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়।

ডেঙ্গু মহামারিতে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ: কেন পিছু হটছে সরকার?

০৬:০৪:৪৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫

২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ইতোমধ্যেই ২০ হাজারের বেশি মানুষ। সরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে ৭৯‑এ। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর, জেলা‑উপজেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এ রোগ। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন নতুন রোগী। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতেও প্রশ্ন উঠছে—সরকার কেন দৃশ্যমান ও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না?

ডেঙ্গুর বিস্তার: শহর থেকে গ্রাম

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি সেন্টারের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী,সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী রাজধানী ঢাকা শহরে। তবে এবার বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো—ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কক্সবাজারসহ অন্যান্য জেলাতেও ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এমনকি পার্বত্য জেলাতেও ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে।

একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, “ডেঙ্গুর এমন বিস্তার গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এবার পরিস্থিতি আরও জটিল, কারণ রোগ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না।”

হিটস্ট্রোকে ১৫ জনের মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সরকারের ব্যর্থতা: কেন প্রতিরোধ কার্যক্রম ব্যাহত

স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সমন্বয়হীনতা ডেঙ্গু প্রতিরোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানীতে দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধনে যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লোক দেখানো এবং দুর্বলভাবে বাস্তবায়িত। মশা নিধনের জন্য যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বহুক্ষেত্রেই কার্যকর নয় বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও নাগরিকরা।

সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে যে কোম্পানি থেকে মশার ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে, তাদের কার্যকারিতা পরীক্ষার কোনো মানদণ্ড মানা হয়নি। ফলে, মশা নিধনে এসব ওষুধ কোনো কাজ করছে না।

ব্যর্থ সচেতনতামূলক কার্যক্রম

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও খুব সীমিত। জনবহুল এলাকায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে কীভাবে পানি জমা বন্ধ রাখতে হবে, কীভাবে ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে—এ নিয়ে কোনো কার্যকর প্রচারণা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, বাসাবাড়ি বা হাসপাতাল—কোথাও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ বা তদারকি নেই।

একজন সচেতন নাগরিক বলেন, “প্রতিবছর বর্ষা এলেই ডেঙ্গু হয়—এটা এখন পুরনো খবর। কিন্তু সরকার যেন প্রতিবছর নতুন করে চমকে ওঠে। কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই।”

স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রস্তুতি

ঢাকার বেশির ভাগ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়েই চলেছে। কোথাও বেড পাওয়া যাচ্ছে না, কোথাও প্রয়োজনীয় প্লেটলেট কিট, ওষুধ বা পরীক্ষা‑নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে ভর্তি না নিয়েই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সের অভাবও এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। জেলা হাসপাতালগুলোতে প্লেটলেট কাউন্ট মেশিন নেই, রক্ত সরবরাহ সীমিত এবং জরুরি ব্যবস্থা একেবারে নাজুক।

আক্রান্তদের দুর্ভোগ: একটি বাস্তব চিত্র

নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আরিফা সুলতানা তাঁর আট বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় এসে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি জানান, “জেলায় হাসপাতালে কোনো সেবা পাইনি, রক্ত পরীক্ষাও হয়নি। পরে বাধ্য হয়ে ঢাকায় আসতে হয়েছে। তাও বেড পাচ্ছি না।”

এই ধরনের অভিজ্ঞতা শুধু তাঁর একার নয়। প্রতিদিন শত শত মানুষ দূর‑দূরান্ত থেকে ঢাকায় এসে চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: সামনে আরও ভয়াবহ হতে পারে

স্বাস্থ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্ষার বাকি সময়ে যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে আগস্ট‑সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বাড়তে পারে। তারা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সমন্বিত অভিযান এবং স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদারের আহ্বান জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, “এই মুহূর্তে দরকার ব্যাপক হারে হটস্পট এলাকায় মশা নিধনের কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ, সক্রিয় তদারকি এবং জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। অন্যথায় হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ আর নেওয়ার মতো থাকবে না।”

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন মৌসুমি সমস্যা নয়; বরং একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য সংকট। এর সমাধান এককভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশন দিয়ে সম্ভব নয়। চাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর সমন্বয়, আধুনিক ওষুধ, প্রশিক্ষিত জনবল এবং জনসম্পৃক্ত সচেতনতা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার যদি এখনই সজাগ না হয়, তবে সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়াবহ বিপর্যয়।