মৃতদের স্মরণে মানুষের দীর্ঘ অভিযাত্রা
পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষ নানা উপায়ে প্রিয়জনের স্মৃতি রক্ষা করেছে। ইসরায়েলের এক গুহায় ১৩ ০০০ বছরের পুরোনো সমাধিতে পুষ্পচূর্ণ পাওয়া যায়; উপমহাদেশজুড়ে ৮ ০০০–৩ ০০০ খ্রিষ্টপূর্বে খুঁজে পাওয়া ডলমেন থেকে শুরু করে আধুনিক সমাধিফলক—সবই মৃত্যু-স্মরণের পরম্পরা। এই ধারায় প্রায় ২ ৩০০ বছর আগে তামিলভাষী প্রাচীন জনপদে নতুন এক স্মৃতিস্তম্ভের প্রচলন ঘটে—নায়কশিলা বা ‘নডুক্কল’।
নায়কশিলার উৎপত্তি ও বিস্তার
আজকের তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও পুদুচেরি থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা ও লক্ষদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে শত শত নায়কশিলা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। অধিকাংশ শিলা স্থানীয় গ্রামবাসীর উদ্যোগে স্থাপিত; এখনো অনেক ক্ষেত্রে সেই গ্রামবাসীদের বংশধররাই সেগুলোর যত্ন করে যাচ্ছেন। সাহসী প্রাণত্যাগ, গবাদিপশু রক্ষা কিংবা জমি বাঁচাতে লড়াই—এরকম আত্মোৎসর্গের কাহিনি এসব শিলায় উৎকীর্ণ। কখনো বন্য পশুর আক্রমণ রোধ, কখনোবা পুরো পরিবারের সম্মিলিত আত্মাহুতি—বিভিন্ন ঘটনার স্মারক হয়ে উঠেছে এই পাথরগুলো।
সাহসিকতার নানা চিত্র
৩য় খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দিন্ডিগল এলাকার এক শিলায় লেখা, “জ্যাকফল গাছের নীচে এই বীরের সমাধি।” ৪র্থ শতকে ভিল্লুপুরমে মোরগের নকশা—গ্রাম্য কুক্কুদের লড়াইয়ে নিহত প্রিয় পাখির স্মরণ। ৬ষ্ঠ শতকের বিরল একটি শিলায় বন্দিত ‘সামি’ নামের এক চোর, যিনি ক্ষুধার্ত গ্রামকে বাঁচাতে গবাদিপশু চুরি করতে গিয়ে প্রাণ দেন। ১০–১২ শতকে নারীদের স্মরণে স্থাপিত বহু শিলাই সতীর ঘটনার ইঙ্গিত বহন করে; সেখানে বধূর হাতে কড়ি-বাঁধানো লেবু ধরা ছবিও দেখা যায়। শিলাগুলিতে কুকুর, মোরগ এমনকি গোটা পরিবারকে পর্যন্ত সম্মানিত করার নজির রয়েছে।
সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিফলন
তৎকালীন সমাজে নৈতিকতা ও সম্মান নির্ধারিত হতো সামষ্টিক কল্যাণের মানদণ্ডে। ভোজ-পার্বণে নায়কশিলা পেখমসজ্জিত করা হতো, পাশে তাড়ি ঢেলে উৎসর্গ বা পশুবলি চলত। রাজা বা দেবতার বদলে সাধারণ মানুষের গৌরবগাথা শিলায় খোদাই—এটি তৎকালীন সমাজের গণতান্ত্রিক চেতনাকেই নির্দেশ করে।
ভাষার পথচিহ্ন
প্রতিটি শিলাই ভাষার বিবর্তনের জীবন্ত দলিল। ৩য়–৫ম শতকে ব্রাহ্মী লিপি, পরবর্তী কালে ভট্টেলুত্তু, আর ৯ম শতকের দিকে আধুনিক তামিল লিপিতে উত্তরণ—শিলালেখই এই পরিবর্তনের সাক্ষ্য দেয়। সরকারি রাজকীয় শিলালিপিতে যেখানে প্রাকৃত ও সংস্কৃত থেকে তামিঝিতে রূপান্তর দেখা যায়, সাধারণ মানুষের স্মৃতিস্তম্ভেও সেই ধারাই প্রতিফলিত।
গবেষণা ও সংরক্ষণ: আধুনিক উদ্যোগ
তামিলনাড়ুর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এবং ‘ইয়াক্কাই হেরিটেজ ট্রাস্ট’-এর মতো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি এসব শিলা গুগল-ম্যাপে জিও-ট্যাগ করছে, নির্মাণকাল ও কাহিনি নথিবদ্ধ করছে। কংগু অঞ্চলে ৫ম–১০ম শতকের ২ ৬৫০-এর বেশি নায়কশিলা শনাক্ত হয়েছে—ভারতীয় উপমহাদেশে যা সর্বাধিক। অধিকাংশ শিলা স্থানীয় কালো পাথরের; প্রাথমিক পর্যায়ে অস্ত্র ও গবাদিপশুর খোদাই, ৬ষ্ঠ শতক থেকে মানবচিত্র, আর ১০ম শতকের পর সাধু-সন্ন্যাসীর স্মরণে শিলা নির্মাণের চল দেখা যায়।
পতনের কারণ ও বর্তমান অবস্থা
ঔপনিবেশিক শাসনের কেন্দ্রীভূত রাজনীতি, সীমানা-কঠোরকরণ ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নায়কশিলার ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যায়। তবু গ্রামীণ মন্দির-গাছতলা কিংবা গ্রামের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি শিলা আজও জানান দেয়—একদা এখানে কোনো বীর লড়েছিলেন বা প্রাণ সমর্পণ করেছিলেন।
বীরদের উত্তরাধিকার
প্রত্নতত্ত্ববিদ কে. রজন বলেন, “প্রতিটি শিলা একটি মানচিত্রের সীমানা, একটি জীবনের সমাপ্তি এবং সমাজের সামষ্টিক চেতনাকে একসূত্রে বেঁধেছে।” ভ্রমণে কোথাও এমন শিলা দেখলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা ‘ইয়াক্কাই হেরিটেজ ট্রাস্ট’-কে জানাবেন—কারণ প্রতিটি বীর তাঁর প্রাপ্য স্মৃতি পাওয়ার অধিকার রাখেন।