সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে
দেশজুড়ে আবারও মারাত্মকভাবে ফিরে এসেছে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারাদেশে কমপক্ষে ৭ হাজার মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি শহরে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশাবাহিত এই ভাইরাসজনিত রোগটি সাধারণত বর্ষাকালে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান মৌসুমে বৃষ্টিপাত, ড্রেনেজ ব্যবস্থার ত্রুটি এবং স্থায়ীভাবে জমে থাকা পানির কারণে মশার বংশবিস্তার বেড়েছে।
কীভাবে ছড়ায় চিকুনগুনিয়া?
চিকুনগুনিয়া মূলত এডিস এজিপ্টাই ও এডিস এলবোপিক্টাস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এডিস মশা দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালের দিকে এবং বিকেলে কামড়ায়। আক্রান্ত মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এটি সংক্রামক হলেও সাধারণত তেমন মারাত্মক বা প্রাণঘাতী নয়, তবে তীব্র ব্যথা ও অক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারে।

উপসর্গ ও জটিলতা
চিকুনগুনিয়ার প্রধান উপসর্গ হলো:
- হঠাৎ জ্বর (১০২-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত)
- তীব্র গাঁটে ব্যথা
- মাথাব্যথা
- চোখে ব্যথা
- ত্বকে র্যাশ
- দুর্বলতা ও ক্লান্তি
অনেক ক্ষেত্রে জ্বর নেমে যাওয়ার পরও গাঁটের ব্যথা টানা মাসের পর মাস থেকে যেতে পারে। শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে জটিলতা আরও মারাত্মক হতে পারে।
চিকিৎসা: কোন পথ?
চিকুনগুনিয়ার এখনো কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বা টিকা নেই। চিকিৎসা মূলত উপসর্গ-ভিত্তিক। যেমন:
- প্যারাসিটামল দিয়ে জ্বর ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণ
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম
- তরল খাবার ও পানির পরিমাণ বাড়ানো
- ব্যথা উপশমে হালকা গরম পানির সেঁক ব্যবহার করা যায়
- কোনো অবস্থাতেই অ্যাসপিরিন বা ব্রুফেন জাতীয় ওষুধ খাওয়া উচিত নয়,কারণ এতে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বেড়ে যায়

প্রতিরোধে যা করতে হবে এখনই
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জনগণকে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে। চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে:
বাড়ি ও আশেপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করুন, বিশেষ করে টব, ফুলদানি, নির্মাণাধীন বিল্ডিং, এসি’র নিচে রাখা পাত্র
প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে মশার স্প্রে ব্যবহার করুন
ঘুমানোর সময় ও দিনে মশারী ব্যবহার করুন
পূর্ণ হাত-পা ঢাকা পোশাক পরিধান করুন, বিশেষ করে শিশুদের জন্য
দরজা-জানালায় জাল লাগান
এলাকাভিত্তিক মশা নিধনের অভিযান বাড়াতে হবে
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা
চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, সিটি করপোরেশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডেঙ্গুর মতোই, চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রেও আগাম উদ্যোগের অভাবে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তরফে দাবি করা হয়েছে যে তারা মশা নিধনে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তবে অনেক এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম অনিয়মিত ও অকার্যকর।
চিকিৎসকদের পরামর্শ
বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেন, রোগটি নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। ডা. সাবরিনা আক্তার, একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, “এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই, তবে অধিকাংশ রোগী ৫-৭ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে যারা গাঁটে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথায় ভুগছেন, তাঁদের নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”
চিকুনগুনিয়া কোনো নতুন রোগ নয়, তবে প্রতিবার সংক্রমণের ঢেউ এলে জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া—যাতে করে দ্রুত মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং চিকুনগুনিয়ার মতো এডিসবাহিত রোগগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। একইসঙ্গে, নাগরিকদেরও নিজের দায়িত্বে ঘরবাড়ি ও পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















