শ্রবণশক্তি আমাদের অন্যতম সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়। কানের ভেতরের ক্ষুদ্র ‘হেয়ার সেল’ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আর পুনরায় জন্মায় না। এ কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি থাকলে তা অবহেলা না করে দ্রুত পরীক্ষা করানো জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রবণশক্তি হ্রাসের সাথে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকিও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
পরিবারে শ্রবণ পরিবর্তনের লক্ষণ
৯০ বছর বয়সী আমার মায়ের শ্রবণ দীর্ঘদিন ভালো ছিল, কিন্তু গত দুই-তিন বছরে পরিবর্তন ধরা পড়ে। প্রথমে তিনি প্রায়ই “কি বললে?” বলতে শুরু করেন, টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দেন এবং পারিবারিক আড্ডায় প্রশ্ন উপেক্ষা করেন। তিনি বলতেন, “শুনি তো, কিন্তু বুঝি না সবাই কি বলছে।” অবশেষে ডাক্তার দেখানোর পর জানা গেল—এটি বয়সজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাস বা ‘প্রেসবাইকিউসিস’।
শ্রবণশক্তি হ্রাস শুধু শব্দের উচ্চতা নয়, বরং কথার স্বচ্ছতাকেও প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, স্বরবর্ণ সাধারণত জোরালো ও নিচু ফ্রিকোয়েন্সির হয়, আর ব্যঞ্জনবর্ণ যেমন ‘ফ’, ‘স’, ‘থ’ তুলনামূলক নরম ও উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির হয়। বয়সজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাসে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি শোনার ক্ষমতা কমে যায়, ফলে শব্দ পার্থক্য বোঝা কঠিন হয়।

পরিসংখ্যান ও পরীক্ষা
সিঙ্গাপুরে ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের প্রায় ১০ শতাংশ এবং ৮০ বছরের বেশি বয়সীদের ৩৫ শতাংশের শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। ৬০ পেরোলেই শ্রবণ পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। পরীক্ষা সহজ: কানে ব্লক বা সমস্যা আছে কিনা দেখা হয়, তারপর শব্দনিরোধী কক্ষে হেডফোন দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতা ও ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ শোনানো হয়।
জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হিয়ারিং নাম্বার’ পদ্ধতিতে শ্রবণ ক্ষমতা মাপা সহজ হয়। বিনামূল্যের অ্যাপ দিয়ে এটি ঘরে বসেই পরীক্ষা করা যায়।
প্রেসবাইকিউসিসের কারণ
ভেতরের ককলিয়ায় থাকা হেয়ার সেল শব্দকে স্নায়ু সিগন্যালে রূপান্তর করে। সময়ের সাথে সাথে এরা ক্ষয় হয় এবং পুনর্জন্ম হয় না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি শনাক্তকারী সেলগুলো, যার ফলে কথার স্বচ্ছতা কমে যায়, বিশেষ করে শব্দপূর্ণ পরিবেশে। অনেক রোগী জানতেও পারে না যে তারা শ্রবণশক্তি হারাচ্ছে—বরং পরিবারের সদস্যরা টিভি বেশি জোরে বাজানো বা বারবার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজনীয়তা দেখে অভিযোগ করে।

শ্রবণশক্তি হ্রাস ও ডিমেনশিয়া
গবেষণায় দেখা গেছে, হালকা শ্রবণশক্তি হ্রাস ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ, মাঝারি হ্রাস তিনগুণ এবং তীব্র হ্রাস পাঁচগুণ বাড়ায়। শ্রবণশক্তি হ্রাসে মস্তিষ্ককে শব্দ প্রক্রিয়াকরণে বেশি কাজ করতে হয়, ফলে স্মৃতি ও চিন্তাশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ কমে গেলে মানসিক অবসাদও বাড়ে।
শব্দ দূষণের ক্ষতি
অত্যধিক শব্দ ককলিয়ার হেয়ার সেল ক্ষতিগ্রস্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, ৮৫ ডেসিবেলের শব্দে ৮ ঘণ্টার বেশি সময় থাকলে শ্রবণশক্তি ক্ষয় হতে পারে। শব্দ যত বেশি, ক্ষতির সময় তত কম। বিশেষজ্ঞরা ভলিউম ৬০ ডেসিবেলের নিচে রাখার পরামর্শ দেন।

হিয়ারিং এইডের ভূমিকা
মাঝারি বা তীব্র শ্রবণশক্তি হ্রাসে হিয়ারিং এইড উপকারী। এগুলো শুধু শব্দ জোরে করে না, বরং নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনে। আধুনিক হিয়ারিং এইড আকারে ছোট, আড়ম্বরপূর্ণ এবং অনেক সময় ইয়ারবাডের মতো দেখতে। দাম প্রায় ১,০০০ থেকে ৯,০০০ ডলার (প্রতি কান), প্রিমিয়াম জোড়া ১৮,০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে এবং প্রায় পাঁচ বছর স্থায়ী হয়। সিঙ্গাপুরে ৬০ বছরের বেশি বয়স্কদের জন্য সরকারি ভর্তুকি রয়েছে।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
আমার মায়ের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—
প্রথমত, শ্রবণশক্তিকে অবহেলা করা যাবে না এবং উচ্চ শব্দ থেকে কানে সুরক্ষা দিতে হবে। আমি ফোনের ভলিউম সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশে সীমিত করেছি।
দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতে দ্বিধা করব না, কারণ এগুলো শুধু শ্রবণশক্তি ফিরিয়ে আনে না, বরং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমায়।
মায়ের নতুন হিয়ারিং এইড ব্যবহারের পর তিনি আরও প্রফুল্ল, স্বচ্ছভাবে চারপাশ শুনতে পাচ্ছেন এবং টিভির ভলিউম অনেক কমে গেছে—তবুও তিনি দুনিয়াকে এখন আগের চেয়ে অনেক স্পষ্ট শুনছেন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















