সমুদ্রজীবনের অদ্ভুত বাসিন্দা
নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইট (Blue-Lipped Sea Krait), বৈজ্ঞানিক নাম Laticauda laticaudata, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানের জগতে এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং রহস্যময় প্রাণী। এরা মূলত পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উষ্ণ সমুদ্রজলে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, আন্দামান সাগরের উপকূল এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রবালপ্রাচীরেও মাঝে মাঝে এদের দেখা মেলে। নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইট শুধু রঙেই নয়, জীবনধারা এবং আচরণেও ভিন্নধর্মী।
দৃষ্টিনন্দন চেহারা ও রঙের মায়া
এই সাপটির গায়ে কালো ও নীলাভ-ধূসর ডোরা দাগ, আর মুখের আশপাশে ও ঠোঁটে গাঢ় নীলাভ আভা থাকায় এর নাম হয়েছে ‘নীলঠোঁট’। দেহ সাধারণত ১ থেকে ১.৫ মিটার লম্বা হয়। ত্বকের উজ্জ্বল রঙ শত্রুর কাছে সতর্ক সংকেতের মতো কাজ করে—“আমাকে এড়িয়ে চলো, আমি বিষধর”। এর লেজ চ্যাপ্টা এবং পাখনার মতো, যা সাঁতারে অসাধারণ গতি ও দক্ষতা দেয়।

বাসস্থান ও অভ্যাস
নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইট মূলত প্রবালপ্রাচীর, অগভীর উপকূল এবং পাথুরে দ্বীপের আশপাশে থাকে। যদিও এটি সময়ের বেশিরভাগ অংশ সমুদ্রে কাটায়, তবুও প্রজনন, বিশ্রাম ও চামড়া বদলের জন্য স্থলভাগে উঠে আসে। রাতের বেলা খাদ্যের খোঁজে সমুদ্রে নামতে পছন্দ করে।
খাদ্যাভ্যাস ও শিকার কৌশল
এই সাপের প্রধান খাবার ছোট মাছ, বিশেষ করে ইল এবং রিফে থাকা মাছ। এরা পানির নিচে অসাধারণ শিকারি—দ্রুত সাঁতরে শিকারের কাছে পৌঁছে বিষাক্ত দাঁতের আঘাতে অচেতন করে ফেলে। নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইটের বিষ নিউরোটক্সিন-সমৃদ্ধ, যা শিকারের স্নায়ুতন্ত্রকে দ্রুত অবশ করে দেয়। মানুষের জন্য এদের কামড় অত্যন্ত বিপজ্জনক, তবে সাধারণত উসকানি না পেলে আক্রমণ করে না।
প্রজনন ও জীবনচক্র
অধিকাংশ সমুদ্রসাপের মতো নয়, নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইট ডিম পাড়ার জন্য স্থলভাগে আসে। মাদী সাপ পাথরের ফাঁক বা সৈকতের নিরাপদ জায়গায় ডিম পাড়ে। ডিম থেকে ছানা বের হওয়ার পরপরই তারা সমুদ্রের পথে রওনা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে এরা বিভিন্ন শিকারি পাখি, বড় মাছ এবং কচ্ছপের শিকার হয়।

বিষ ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইটের বিষ মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে, তবে এরা খুব শান্ত স্বভাবের। ডাইভার ও মৎস্যজীবীদের আশপাশে প্রায়ই সাঁতার কাটলেও সচেতনভাবে দূরত্ব বজায় রাখে। তবুও, দুর্ঘটনাজনিত সংস্পর্শ এড়াতে সতর্ক থাকা জরুরি। সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানীরা তাদের আচরণ ও বিষের গঠন নিয়ে গবেষণা করছেন, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নতুন ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগতে পারে।
সংরক্ষণ অবস্থা ও হুমকি
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইটকে বর্তমানে “Least Concern” তালিকায় রেখেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রবালপ্রাচীর ধ্বংস, সামুদ্রিক দূষণ ও অতিরিক্ত মাছ ধরা এদের বাসস্থানের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কিছু অঞ্চলে বিষ সংগ্রহ বা চামড়ার জন্যও এদের ধরা হয়।

সমুদ্রের ভারসাম্যে ভূমিকা
নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইট সামুদ্রিক খাদ্যচক্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ছোট মাছ ও ইল নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা প্রবালপ্রাচীরের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। তাই এদের সংরক্ষণ শুধু একটি প্রজাতি নয়, পুরো সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য জরুরি।
কৌতূহলের বিষয়
নীলঠোঁট সমুদ্র-ক্রেইট সৌন্দর্য, রহস্য ও বিপদের এক অসাধারণ মিশ্রণ। তারা যেমন প্রকৃতির এক শিল্পকর্ম, তেমনি সমুদ্রের নিঃশব্দ রক্ষকও। সমুদ্রপ্রেমী ও গবেষকদের কাছে এই প্রাণী শুধু কৌতূহলের বিষয় নয়, বরং সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের এক অমূল্য সম্পদ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















