অলিভ-হেডেড সি সাপ (Hydrophis major) সমুদ্রজগতে এক বিশেষ প্রজাতি, যা মূলত ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণ উপকূলীয় অঞ্চলে দেখা যায়। এর মাথার রঙ অলিভ সবুজ হওয়ায় একে এই নামে চিহ্নিত করা হয়। সমুদ্র সাপদের মধ্যে এটি আকারে বেশ বড় এবং শক্তিশালী প্রজাতি।
আকার ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য
এই সাপের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.৫ থেকে ২ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর মাথা গোলাকার ও প্রশস্ত, যা শরীরের তুলনায় স্পষ্টভাবে আলাদা। শরীরের রঙ ধূসর থেকে সবুজাভ বাদামি, আর পেটের অংশ অপেক্ষাকৃত ফ্যাকাসে। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মাথার অলিভ রঙ এবং শরীরজুড়ে কালো ডোরা বা ফোঁটা।
অলিভ-হেডেড সি সাপের লেজ চাপা এবং চ্যাপ্টা, যা পানিতে সহজে সাঁতার কাটতে সহায়তা করে। এদের ফুসফুস শরীরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে বিস্তৃত, ফলে দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকতে পারে।
আবাসস্থল
এই সাপ সাধারণত অগভীর উপকূলীয় সমুদ্র, নদীর মোহনা, প্রবালপ্রাচীর এবং ম্যানগ্রোভ অরণ্যে পাওয়া যায়। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ ও আন্দামান সাগর হলো এর মূল আবাসস্থল।

খাদ্যাভ্যাস
অলিভ-হেডেড সি সাপ মূলত মাছ খায়। এর শিকার কৌশল অত্যন্ত দক্ষ—এরা পানির নিচে মাছের দল ঘিরে ফেলে এবং হঠাৎ আক্রমণ করে। এদের বিষ শিকারকে দ্রুত অচল করে দেয়। মাঝে মাঝে চিংড়ি বা অন্যান্য ছোট সামুদ্রিক প্রাণীকেও খেয়ে থাকে।
বিষ ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক
এই সাপ অত্যন্ত বিষধর। এর নিউরোটক্সিন শিকারের স্নায়ুতন্ত্রকে দ্রুত আক্রমণ করে। তবে মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের ঘটনা খুব কম। সাধারণত এরা মানুষকে এড়িয়ে চলে, কিন্তু জেলেদের জালে আটকা পড়লে বা বিরক্ত করা হলে কামড় দিতে পারে। কামড় প্রাণঘাতী হতে পারে, তাই সতর্ক থাকা জরুরি।
প্রজনন
অলিভ-হেডেড সি সাপ ডিম পাড়ে না, বরং সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে (ভিভিপ্যারাস)। স্ত্রী সাপ সাধারণত ৫ থেকে ১০টি শাবক জন্ম দেয়। বাচ্চারা জন্মের পর থেকেই সাঁতার কাটতে ও শিকার ধরতে সক্ষম।
পরিবেশগত গুরুত্ব
এরা সামুদ্রিক পরিবেশে ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাছের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে খাদ্যশৃঙ্খলকে সুষম রাখে। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যে সাপদের অবদান অনেক, যদিও আমরা প্রায়ই তাদের ভয়ের চোখে দেখি।

হুমকি ও সংরক্ষণ
অলিভ-হেডেড সি সাপ বর্তমানে নানা হুমকির মুখে:
- জেলেদের জালে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু
- উপকূলীয় দূষণ
- প্রবালপ্রাচীর ধ্বংস
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
যদিও এ প্রজাতি এখনো “গুরুতর বিপন্ন” শ্রেণিতে পড়েনি, তবে সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, যদি আবাসস্থল ধ্বংস হতে থাকে তবে ভবিষ্যতে এর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা ও স্থানীয় অভিজ্ঞতা
অলিভ-হেডেড সি সাপ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বহু গবেষণা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামুদ্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ প্রজাতির সংখ্যা, চলাচল ও আচরণ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এরা প্রতি বছর নির্দিষ্ট এলাকায় প্রজননের জন্য ভিড় জমায়।

বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে জেলেদের জালে প্রায়ই এ সাপ ধরা পড়ে। স্থানীয় জেলেদের অভিজ্ঞতা বলছে, এরা সাধারণত আক্রমণ করে না, তবে জালে আটকা পড়লে ছটফট করতে গিয়ে অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক জেলে ভয় পেয়ে সাথে সাথে এ সাপকে মেরে ফেলে, যা প্রজাতিটির টিকে থাকার ক্ষেত্রে হুমকি।
আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ সংগঠনগুলো ইতিমধ্যেই স্থানীয় জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন: ‘ক্যাচ অ্যান্ড রিলিজ’ (ধরে ছেড়ে দেওয়া) পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে জেলেদের, যাতে তারা সাপকে না মেরে পানিতে ফিরিয়ে দিতে পারে। একইসঙ্গে উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষায় প্রবালপ্রাচীর সংরক্ষণ ও দূষণ কমানোর ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে।
অলিভ-হেডেড সি সাপ প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। এর রহস্যময় সৌন্দর্য যেমন সমুদ্রকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এর ভূমিকা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় অপরিহার্য। তাই এ প্রজাতির সুরক্ষা শুধু সাপের অস্তিত্ব নয়, বরং সমগ্র সমুদ্রজগতের টিকে থাকার জন্যই জরুরি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















