গাজীপুরের এক তরুণ—আমরা তাঁকে ডাকনাম ধরে বলি রাহাত। মাত্র সাত মাস আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন একটি পোশাক কারখানার কর্মচারী। মেশিনের শব্দ আর সুঁই-সুতোয় কাটত তাঁর প্রতিদিন। কিন্তু হঠাৎই সবকিছু বদলে গেল। সেই কারখানা থেকে চাকরি হারিয়ে এখন রাহাতকে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হঠাৎ জীবনের মোড়
চাকরি হারানোর আগে রাহাতের জীবন ছিল সাধারণ, কিন্তু স্থির। মাস শেষে হাতে আসত বেতন, ভাড়া দেওয়া যেত, সংসারের চাল-ডাল কিনতে অসুবিধা হতো না। কিন্তু সাত মাস আগে মালিকানা ও অর্ডারের জটিলতায় যখন কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করল, তখনই বাদ পড়লেন তিনি। হাতে জমা ছিল না তেমন কোনো টাকা। ফলে জীবন এক নিমিষেই অচেনা হয়ে গেল।
পরিবারের বোঝা, অনিশ্চিত আগামী
রাহাতের সংসারে আছেন বৃদ্ধ মা, স্ত্রী আর দুই ছোট সন্তান। সংসারের চাল চেয়ে প্রতিদিন নতুন লড়াই শুরু হয়। সন্তানদের স্কুলে পাঠানো, মায়ের ওষুধ কেনা—সবই এখন তাঁর কাঁধে বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারখানার চাকরি হারানোর পর তিনি দিনমজুরি, রিকশা চালানো কিংবা বাজারে খুচরো কাজ—যা পান তাই করেন।
কিন্তু এই আয়ের ধারাবাহিকতা নেই। কখনো দিনে ৪০০ টাকা, আবার কখনো ২০০ টাকাতেও শেষ হয় তাঁর খাটুনি। এতে সংসারের চাহিদা মেটানো তো দূরের কথা, ভাড়া মেটাতেই হিমশিম খেতে হয়।

লজ্জা আর সংগ্রামের মাঝে
একসময় কারখানার নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষে পরিবারকে নিয়ে বসতেন তিনি। আজ সেই দিনগুলো শুধুই স্মৃতি। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ধার চাওয়ার লজ্জা, দোকানদারের কাছে বাকির খাতা—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন যেন এক অশেষ অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিয়েছে।
রাহাত বলেন, “চাকরিটা ছিল জীবনের ভরসা। এখন প্রতিদিন ভাবি, কাল কী করব, বাচ্চাদের জন্য কী খাবার জোগাড় করব।”
ভাঙা স্বপ্ন থেকে টিকে থাকার লড়াই
চাকরি হারানোর ধাক্কা তাঁকে ভেঙে দিয়েছে, কিন্তু হার মানতে চান না রাহাত। তিনি চেষ্টা করছেন ছোটখাটো ব্যবসা বা কোনো কারখানায় আবার ঢোকার। কিন্তু কাজের সুযোগ সীমিত, প্রতিযোগী অনেক। তবু স্বপ্ন দেখেন—একদিন হয়তো আবার নিয়মিত আয়ের ভরসায় ফিরতে পারবেন।

গাজীপুরের পোশাক শিল্প ও শ্রমিক বাস্তবতা
গাজীপুর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। প্রতিদিন এখানে লাখো শ্রমিক ভোর থেকে রাত পর্যন্ত মেশিনের শব্দে ডুবে কাজ করেন। রপ্তানির অর্ডার বাড়লে যেমন চাকরির সুযোগ তৈরি হয়, তেমনি বিশ্ববাজারে মন্দা বা রাজনৈতিক অস্থিরতা এলে প্রথম ধাক্কা লাগে শ্রমিকদের ওপরেই।
শ্রমিক সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে গাজীপুর অঞ্চলে কয়েক হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। যাঁরা বেকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই অন্য কোনো শিল্পে স্থানান্তর হতে পারছেন না। কারণ, দক্ষতা সীমিত, আবার নতুন জায়গায় সুযোগও অল্প। ফলে বেশিরভাগ শ্রমিককে বিকল্প জীবিকার পথে যেতে হচ্ছে—যেমন রিকশা চালানো, দিনমজুরি করা কিংবা ছোট দোকান বসানো।
রাহাতের মতো আরও অনেক শ্রমিক প্রতিদিন নতুন সংগ্রামের মুখোমুখি হন। তাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা ঝুঁকির মুখে পড়ে, মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে পরিবার ঋণে জর্জরিত হয়। সমাজে নীরবভাবে বাড়তে থাকে হতাশা আর অস্থিরতা।
এই পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তিগত জীবনের সংকট নয়, জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলে। পোশাকশিল্প বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত হলেও শ্রমিকরা যদি টিকে থাকতে না পারেন, তবে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ অবস্থা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ বাড়িয়ে দেয়।

দৈনন্দিন জীবনের টানাপোড়েন
রাহাত ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, কখনো ফজরের আজানের আগেই। ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মাথায় ভর করে দুশ্চিন্তা—আজ কী কাজ পাওয়া যাবে? কোথায় গেলে খাটুনি মিলবে? রিকশার মালিককে ভাড়া মেটাতে পারব তো?
সকালবেলা রুটি-ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কখনো স্থানীয় বাজারে মাল খালাস করেন, কখনো কোনো গ্যারেজে ছোটখাটো কাজ ধরেন। আবার কখনো দিনভর রিকশা চালিয়ে রাত হলে ঘরে ফেরেন। কিন্তু প্রতিদিনই যে কাজ পান, তা নয়। আর কাজ না পেলে ঘরে ফেরা মানে সন্তানদের মুখে নিরাশা দেখা।
স্ত্রী সেলিনা মাঝে মাঝে পাশের বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। দিনে হয়তো ১০০–১৫০ টাকা আয় হয়। কিন্তু সেটা সংসারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নগণ্য। রাহাত বলেন, “স্ত্রী-সন্তানকে না খাইয়ে রেখে বাইরে খাটতে যায় কীভাবে? একেকদিন মনে হয় আর পারব না। তারপরও চেষ্টা করি।”
অন্য শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা
রাহাতের মতো একই গলির বাসিন্দা জহিরুলও সাত মাস আগে চাকরি হারিয়েছেন। আগে একটি বড় কারখানায় কাজ করতেন, এখন ইটভাটায় শ্রমিক। তিনি বলেন, “কারখানায় মেশিনে কাজের অভ্যাস ছিল, এখানে এসে প্রতিদিন ইট টেনে কোমর ভেঙে যায়। কিন্তু পরিবার চালাতে হবে তো।”
আরেকজন শ্রমিক, রুবেল, একসময় লাইন চিফ ছিলেন। আজ তিনি দিনমজুরি করেন। তাঁর কথায়, “শ্রমিকের কষ্ট কেউ বোঝে না। খবরের কাগজে লেখা হয় মালিক কত রপ্তানি করল, কিন্তু আমরা যারা কাজ হারালাম—আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না।”

সমাজ ও অর্থনীতির প্রভাব
এই বেকারত্ব শুধু পরিবারকেই ধ্বংস করছে না, সমাজেও ফেলছে নেতিবাচক প্রভাব। স্কুলপড়ুয়া অনেক শিশু বই-খাতা ছেড়ে কাজে নেমে যাচ্ছে। মেয়েদের স্কুল ছাড়িয়ে কম বয়সে বিয়ের চাপ বাড়ছে। তরুণরা কাজ না পেয়ে হতাশায় ভুগছে। এর প্রভাব সরাসরি সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর পড়ছে।
অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এভাবে শ্রমিকরা ক্রমাগত বেকার হলে রপ্তানি খাত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দক্ষ শ্রমিক হারিয়ে গেলে শিল্পপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। তাছাড়া এক শ্রেণির মানুষ যখন ক্রয়ক্ষমতা হারায়, তখন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারও দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
বাংলাদেশ শ্রমনীতি ফোরামের গবেষক ড. ফারুক আহমেদ বলেন, “গাজীপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে চাকরি হারানো প্রতিটি শ্রমিকের কাহিনি আসলে একটি বড় সামাজিক সংকটের প্রতিফলন। সরকার যদি বেকার শ্রমিকদের পুনর্বাসন, দক্ষতা উন্নয়ন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের উদ্যোগ না নেয়, তবে এই সংকট আরও গভীর হবে। শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকলেই হবে না, আমাদের স্থানীয় শ্রমিকদের জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখাও জরুরি।”
শ্রম অর্থনীতিবিদ নাজমা সুলতানা মনে করেন, “প্রতিটি শ্রমিকই একটি পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। একজন শ্রমিকের আয় বন্ধ মানে একটি পুরো পরিবার সংকটে পড়া। তাই রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নের সময় শ্রমিকের জীবনমানকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত।”
রাহাতের এই গল্প আসলে হাজারো গাজীপুরি শ্রমিক পরিবারের প্রতিচ্ছবি। চাকরি হারানো মানে শুধু আয়ের ক্ষতি নয়—তা মানসিক অস্থিরতা, সামাজিক সংকট এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ডেকে আনে। তবু জীবন থেমে থাকে না। প্রতিদিন নতুন করে লড়াই করতে হয়, বাঁচার জন্য, সন্তানের মুখে হাসি রাখার জন্য।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















