ভ্যাকুইটা (Phocoena sinus) পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল এবং বিপন্ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এটি এক প্রকার পোরপয়েজ, যা দেখতে ডলফিনের মতো হলেও আলাদা বৈশিষ্ট্য বহন করে। মাত্র কয়েক দশক আগেও এর সংখ্যা ছিল শতাধিক, কিন্তু বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
ভ্যাকুইটার আবিষ্কার ও ইতিহাস
ভ্যাকুইটা খুবই দেরিতে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত হয়। ১৯৫৮ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম ক্যালিফোর্নিয়ার উপসাগরের উত্তর অংশে এটি আবিষ্কার করেন। এর আগে স্থানীয় জেলেরা মাঝে মধ্যে এই প্রাণীকে চিনলেও বৈজ্ঞানিক জগতে এর অস্তিত্ব নিয়ে কোনো তথ্য ছিল না। এত দেরিতে আবিষ্কৃত হওয়াটাই প্রমাণ করে এটি কতটা দুর্লভ ও অদৃশ্য প্রবণ প্রাণী।
শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য
- দৈর্ঘ্য:সাধারণত ১.২ থেকে ১.৫ মিটার
- ওজন:গড়ে ৪০-৫৫ কিলোগ্রাম
- দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্য:চোখের চারপাশে গাঢ় কালো দাগ, ঠোঁটের চারপাশে কালো ছোপ।
- রঙ:পিঠে ধূসর, পেটে সাদা।
- দাঁত:ছোট ও খাঁজকাটা দাঁত, যা দিয়ে ছোট মাছ ও চিংড়ি জাতীয় প্রাণী খায়।
এটি দেখতে নরম ও শান্ত হলেও সমুদ্রে এরা খুব দ্রুত গতিতে চলাচল করতে পারে।

জীবনধারা ও স্বভাব
ভ্যাকুইটা একাকী স্বভাবের প্রাণী। সাধারণত ২-৩ সদস্যের ছোট দলে থাকে, তবে অনেক সময় একাই চলাফেরা করে।
- অভ্যাস:পানির ওপর লাফিয়ে ওঠা বা কসরত করার প্রবণতা নেই।
- শ্বাস নেওয়া:প্রতি ২০-২৫ সেকেন্ড অন্তর বাতাস নিতে পানির ওপরে আসে।
- প্রজনন:স্ত্রী ভ্যাকুইটা প্রতি দুই বছরে একবার বাচ্চা জন্ম দেয়। গর্ভকাল প্রায় ১০-১১ মাস।
এই ধীর প্রজনন হার তাদের বিলুপ্তির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
খাদ্যাভ্যাস
ভ্যাকুইটার খাদ্যতালিকায় থাকে অগভীর সমুদ্রের ছোট মাছ, স্কুইড, অক্টোপাস এবং চিংড়ি-জাতীয় প্রাণী। তারা রাতে খাবার সংগ্রহ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
বিস্তৃতি ও আবাসস্থল
ভ্যাকুইটা কেবলমাত্র মেক্সিকোর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়ার উপসাগরের (Sea of Cortez) অগভীর জলে পাওয়া যায়। এত সীমিত আবাসভূমির কারণে এরা অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়তে পারেনি।

বিলুপ্তির প্রধান হুমকি
ভ্যাকুইটার অস্তিত্ব এখন এক সুতোয় ঝুলছে। এর প্রধান হুমকিগুলো হলো:
অবৈধ মাছ ধরা ও গিলনেট (gillnet): টোটোবা নামের মাছ ধরতে ব্যবহার করা বড় জালে ভ্যাকুইটা সবচেয়ে বেশি আটকা পড়ে মারা যায়।
সীমিত আবাসভূমি: একমাত্র নির্দিষ্ট এলাকায় থাকায় পরিবেশগত যেকোনো বিপর্যয়ে সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মানব কার্যকলাপ: দূষণ, নৌযান চলাচল, শব্দদূষণ এবং সামুদ্রিক খনিজ আহরণ তাদের বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
খাদ্য সংকট: অতিরিক্ত মাছ ধরার কারণে তাদের খাদ্যের প্রাপ্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
বর্তমান অবস্থা
২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীতে ২০টিরও কম ভ্যাকুইটা জীবিত আছে। কিছু সমীক্ষা বলছে হয়তো মাত্র ১০-১২টি ভ্যাকুইটা এখনো টিকে আছে। ফলে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সংকটাপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী।

সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
ভ্যাকুইটা রক্ষার জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে:
- মেক্সিকো সরকার ভ্যাকুইটার বাসভূমিতে গিলনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে।
- আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থাWWF, IUCN, Sea Shepherd Conservation Society প্রভৃতি সংগঠন টহল জোরদার করেছে।
- গবেষকরা‘ভ্যাকুইটা সেফ নেট’ নামের নতুন ধরনের জাল তৈরি করার চেষ্টা করছেন, যাতে মাছ ধরা সম্ভব হলেও ভ্যাকুইটা আটকা না পড়ে।
- স্থানীয় জনগণকে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে সংরক্ষণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে।
তবে এখন পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি খুব সীমিত। প্রাণীটির সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে বিলুপ্তি ঠেকানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
- IUCN-এর বিজ্ঞানীরাবলছেন, “ভ্যাকুইটা হলো মানবসৃষ্ট হুমকির সবচেয়ে বড় শিকার। যদি অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, এটি আমাদের চোখের সামনেই হারিয়ে যাবে।”
- WWF-এর বিশেষজ্ঞদের মতে,ভ্যাকুইটা কেবল একটি প্রাণী নয়, এটি মেক্সিকোর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতীক।

ভ্যাকুইটার গুরুত্ব
ভ্যাকুইটা হারিয়ে গেলে শুধু একটি প্রজাতি নয়, বরং সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ভেঙে পড়বে। ছোট প্রাণী খাওয়ার মাধ্যমে এটি খাদ্যশৃঙ্খলকে ভারসাম্যপূর্ণ রাখে। এর বিলুপ্তি মানে হবে একটি ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের ভেঙে পড়া।
সম্ভাব্য সমাধান ও ভবিষ্যৎ কৌশল
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এখনো সময় আছে ভ্যাকুইটাকে বাঁচানোর। এর জন্য প্রয়োজন:
- গিলনেট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে বিকল্প নিরাপদ মাছ ধরার জাল প্রচলন।
- স্থানীয় জেলেদের আর্থিক সহায়তা ও বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত করা।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানো,বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে যৌথ টহল ব্যবস্থা।
- প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভ্যাকুইটার চলাচল পর্যবেক্ষণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন কর্মসূচি শুরু করা।
- সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এই প্রাণীকে একটি‘জাতীয় প্রতীক’ হিসেবে রক্ষা করা।
ভ্যাকুইটা আজ পৃথিবীর বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী। মাত্র কয়েকটি জীবিত নমুনা হয়তো এখনো লড়াই করে টিকে আছে। প্রশ্ন হলো—মানবজাতি কি এখনো সময় আছে এই “সমুদ্রের ভূত”কে বাঁচানোর? নাকি খুব শীঘ্রই ভ্যাকুইটা পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি হারানো অধ্যায় হয়ে যাবে?
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















