শৈশব ও প্রাথমিক জীবন
নাজারিয়া নাজিম (Nazriya Nazim) দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা। তিনি ১৯৯৪ সালের ২০ ডিসেম্বর কেরালার তিরুবনন্তপুরমে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবের একটি বড় সময় কেটেছে আরব আমিরাতে, যেখানে তার পরিবার বসবাস করত। পরবর্তীতে পড়াশোনার জন্য তিনি কেরালায় ফিরে আসেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি শিল্প ও অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
অভিনয়ে প্রবেশ
নাজারিয়া প্রথমে টেলিভিশনের পর্দায় শিশু শিল্পী হিসেবে হাজির হন। পরে উপস্থাপিকা হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ২০০৬ সালে তিনি প্রথমবার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ব্লেসি পরিচালিত ‘Palunku’ সিনেমায়। খুব অল্প বয়সেই তার অভিনয় দক্ষতা দর্শকদের নজর কাড়ে।
নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ
নায়িকা হিসেবে নাজারিয়ার আসল যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে ‘Maad Dad’ ছবির মাধ্যমে। কিন্তু তিনি ব্যাপক আলোচনায় আসেন আলফন্স পুথরেন পরিচালিত ‘Neram’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, যা একসঙ্গে মালায়ালম ও তামিল ভাষায় নির্মিত হয়। এ ছবির সাফল্যের পর তিনি আর পিছনে ফিরে তাকাননি।
চারটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র
Ohm Shaanthi Oshaana (2014)
নাজারিয়া এখানে পূজা ম্যাথিউ নামের প্রাণবন্ত তরুণীর চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমাটি ছিল নারী-প্রধান, যেখানে নায়িকাই গল্পকে এগিয়ে নিয়েছে। এই অভিনয়ের জন্য তিনি কেরালা স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পান।
Bangalore Days (2014)
আনজলি মেনন পরিচালিত এ ছবিতে তিনি “কুত্তি” চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিটি তরুণ প্রজন্মের আবেগ, বন্ধুত্ব ও সম্পর্কের গল্প। নাজারিয়ার স্বাভাবিক অভিনয় তাকে দর্শকদের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে।
Raja Rani (2013)
তামিল সিনেমা ‘Raja Rani’-তে নাজারিয়ার চরিত্রটি ছোট হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার আবেগঘন অভিনয় কাহিনিকে গভীরতা দিয়েছে এবং দর্শকের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলেছে।
Koode (2018)
দীর্ঘ বিরতির পর তিনি অভিনয়ে ফিরে আসেন এই ছবির মাধ্যমে। এখানে তিনি “জেনি” চরিত্রে অভিনয় করেন, যে ভাইয়ের জীবনে আত্মারূপে ফিরে আসে। ছবিটি নাজারিয়ার জন্য পুনরাগমনের সাফল্যের প্রতীক।
বিবাহ ও ব্যক্তিজীবন
২০১৪ সালে নাজারিয়া নাজিম বিখ্যাত অভিনেতা ফাহাদ ফাসিলকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর কয়েক বছরের জন্য তিনি চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যান। তবে ২০১৮ সালে ফিরে এসে আবারও নিজের অভিনয় দক্ষতায় দর্শকদের মুগ্ধ করেন।
সম্মাননা ও অর্জন
‘Ohm Shaanthi Oshaana’–এর জন্য তিনি কেরালা স্টেট ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি বহুবার সমালোচকদের প্রশংসা এবং ভক্তদের ভালোবাসা পেয়েছেন।
সমালোচকদের মন্তব্য ও বাণিজ্যিক সাফল্য
নাজারিয়ার চলচ্চিত্রগুলো কেবল বাণিজ্যিকভাবেই সফল হয়নি, সমালোচকরাও তার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। ‘Ohm Shaanthi Oshaana’ মুক্তির পর সমালোচকেরা উল্লেখ করেন যে নাজারিয়া মালায়ালম সিনেমায় এক নতুন ধারা এনেছেন—যেখানে নায়িকা কেবল গল্পের অংশ নন, বরং গল্পকে চালিত করার কেন্দ্রবিন্দু।
‘Bangalore Days’ বক্স অফিসে ছিল বিশাল সাফল্য এবং তরুণ প্রজন্মের সিনেমা হিসেবে একটি মাইলফলক। এই ছবির মাধ্যমে নাজারিয়ার জনপ্রিয়তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
‘Raja Rani’ সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায় কারণ নাজারিয়ার অভিনয় ছোট চরিত্র হয়েও আবেগের গভীরতা তৈরি করতে পেরেছিল। ছবিটি বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়।
‘Koode’ মুক্তির পর দর্শকরা নাজারিয়ার প্রত্যাবর্তনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। সমালোচকরা মন্তব্য করেন যে তিনি আগের চেয়ে আরও পরিণত ও গভীর অভিনয় উপহার দিয়েছেন।
চলচ্চিত্র জগতের সমসাময়িক প্রভাব ও নাজারিয়ার ভূমিকা
নাজারিয়া নাজিম দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক ভিন্ন ধারা তৈরি করেছেন। তিনি এমন সময় নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, যখন নারী চরিত্রগুলো মূলত গল্পের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু নাজারিয়া নিজের অভিনয়ের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে একজন নায়িকা গল্পের চালিকাশক্তিও হতে পারেন। তার অভিনীত ‘Ohm Shaanthi Oshaana’–এর সাফল্য প্রমাণ করে যে নারী-প্রধান সিনেমাও সমানভাবে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে পারে।
তিনি একদিকে তরুণ দর্শকদের কাছে “গার্ল নেক্সট ডোর”–এর প্রতীক হয়ে উঠেছেন, আবার অন্যদিকে সমালোচকদের কাছে হয়েছেন বহুমুখী প্রতিভার প্রতিচ্ছবি। তার উপস্থিতি মালায়ালম, তামিল ও তেলুগু—তিনটি ইন্ডাস্ট্রিতেই নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তরুণ প্রজন্মের অভিনেত্রীদের জন্য নাজারিয়া একটি অনুপ্রেরণার নাম, যিনি ব্যক্তিজীবন, ক্যারিয়ার বিরতি এবং প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েও নিজের সাফল্য ধরে রেখেছেন।
নাজারিয়ার ক্যারিয়ারের প্রতিটি ধাপকে যদি বিশ্লেষণ করা হয়, দেখা যাবে তিনি কেবল বাণিজ্যিকতার জন্য সিনেমায় কাজ করেননি। তার প্রতিটি ছবিতে একটি সামাজিক বা আবেগঘন বার্তা বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, ‘Ohm Shaanthi Oshaana’ নারীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আত্মবিশ্বাসী জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
‘Bangalore Days’ সিনেমা তরুণ প্রজন্মের স্বপ্ন, ভাঙন ও সম্পর্কের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যেখানে নাজারিয়া ছিলেন গল্পের প্রাণকেন্দ্র। ‘Raja Rani’ দেখিয়েছে কীভাবে একজন অভিনেত্রী অল্প সময়ের উপস্থিতিতেও কাহিনি পরিবর্তন করতে পারেন। আর ‘Koode’–এর মাধ্যমে তিনি নতুন করে প্রমাণ করেছেন—ভালো অভিনেত্রীরা সময়ের পরীক্ষায় টিকে থাকেন।
তার অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বাণিজ্যিক সাফল্য দক্ষিণ ভারতের সিনেমা জগতকে প্রমাণ করেছে যে নারীকেন্দ্রিক কাহিনি শুধু শিল্প নয়, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও সমানভাবে সফল হতে পারে। এই ধারা আজকের নতুন প্রজন্মের পরিচালক ও প্রযোজকদেরও অনুপ্রাণিত করছে।
নাজারিয়া নাজিম একজন প্রাণবন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রতিভাবান অভিনেত্রী। তার অভিনয় জীবনের প্রতিটি ধাপে তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি কেবল একজন বাণিজ্যিক নায়িকা নন, বরং এমন একজন শিল্পী যিনি গল্পকে নিজের অভিনয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী করে তুলতে পারেন। শৈশব থেকে চলচ্চিত্রে প্রবেশ, নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ, চারটি বিখ্যাত ছবিতে অনবদ্য অভিনয়, বিয়ের কারণে বিরতি এবং পরবর্তী প্রত্যাবর্তন—সব মিলিয়ে নাজারিয়ার জীবন ও কর্মজীবন দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে।