মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক বোমায় আলোড়ন পড়েছে বিশ্বে। ভারতের উপরে সে জন্য অনেকটাই চাপ তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক না মিটতে এবার নয়া নির্দেশ জারি হোয়াইট হাউসের।
ট্রাম্পের নয়া নির্দেশ
অ্যামেরিকার এই নির্দেশ এইচ-ওয়ান বি ভিসা সংক্রান্ত। এই ভিসা দেয়া হয় সে দেশের অভিবাসীদের। অর্থাৎ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যখন কেউ অ্যামেরিকায় সাময়িকভাবে বসবাস করেন, তাদের এই ভিসা লাগে। ১৯৯০ সালে অভিবাসী ভিসা চালু হয়। যে ভিসার মাধ্যমে ভারতীয়-সহ বিভিন্ন দেশের বহু মানুষ কর্মসূত্রে অ্যামেরিকায় বসবাস করেন। তাদের মাথায় এখন বাজ পড়ার অবস্থা।
কী বলা হয়েছে নয়া নির্দেশে? বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ করতে হলে অ্যামেরিকার সংস্থাকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হবে। এই টাকা আদায় করবে ওয়াশিংটনের সরকার। বছরে এক লক্ষ ডলার প্রতি কর্মী পিছু নেয়া হবে। অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা। কোনো বিশেষ দেশের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়নি। তবে দীর্ঘদিনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই ধরনের ভিসার জন্য সবচেয়ে বেশি আবেদন করেন ভারতীয় নাগরিকরা।
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, গত বছরে ৭১ শতাংশ ভারতীয়র আবেদন অনুমোদিত হয়েছে। অনেক পিছনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন। সে দেশের নাগরিকদের ভিসা প্রাপ্তির হার ১২ শতাংশের কম। অ্যামাজন, মেটা, মাইক্রোসফট-সহ বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করতে ভিসা নিয়েছেন ভারতীয়রা।
আবেদন মঞ্জুর হওয়ার সময়ে তিন বছরের মেয়াদ থাকে এইচ-ওয়ান বি ভিসার। মেয়াদ সর্বাধিক ছয় বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়। এরই মধ্যে স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারেন অভিবাসীরা। গ্রিন কার্ড না পাওয়া পর্যন্ত ভিসার উপরে নির্ভর করেই থাকতে হয় অ্যামেরিকায়। ট্রাম্পের নির্দেশ অনুযায়ী, এই ভিসার জন্য বিপুল টাকা ধার্য করা হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার উপরে। এই টাকার বোঝা ট্রাম্পের উপরে চাপলেও শেষমেশ চাকরিপ্রার্থী অভিবাসীর থেকে তা আদায় করা হতে পারে, এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে অনেকের ক্ষেত্রে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
নয়া নীতির সমস্যা
২০২৪-এর জানুয়ারির আগে পর্যন্ত এইচ-ওয়ান বি ভিসার রেজিস্ট্রেশন ছিল মাত্র ১০ ডলার। জানুয়ারির পরে ২০০-র বেশি কিছু ডলার বাড়ানো হয়েছিল। তারপর এটা বাড়িয়ে করা হলো এক লক্ষ ডলার।
এর ফলে ভারতীয়দের সমস্যা কতটা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া স্টাডিজের বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, “ভারতীয়রাই সবচেয়ে বেশি অ্যামেরিকায় গিয়ে কাজ করেন। ৭০-৭২ শতাংশ। তারা মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার ডলার রোজগার করেন। নিয়োগকারী সংস্থা যদি কর্মীদের কাছ থেকে এই টাকাটা তুলে নেন, তাহলে তো কর্মীদের রোজগারই থাকছে না। নতুন প্রজন্ম যারা আগামী দিনে চাকরির জন্য অ্যামেরিকার কথা ভাবছিল, তাদের স্বপ্ন ধাক্কা খেলো।”
এর ফলে প্রবাসী প্রেরিত অর্থ বা রেমিট্যান্স কমে যাবে অনেকটাই, ফলে আয় কমবে। রাজাগোপাল বলেন, “ভারতীয় ১৫০ কোম্পানি অ্যামেরিকায় গিয়ে নানা ভাবে ব্যবসা করছে। ভারতীয়দের অনেক আইটি স্টার্ট আপ তৈরি হচ্ছে। সেখানে ব্যবসা প্রচুর। বছরে ১৩০ বিলিয়ন ডলার আমরা রেমিট্যান্স থেকে আয় করি। শুধু অ্যামেরিকা থেকেই তার ৩০ শতাংশ আসে। এর বড় অংশটাই আসে এইচ-ওয়ান বি ভিসা হোল্ডার থেকে। যেহেতু এরা স্থায়ীভাবে থাকতে পারেন না, তাই এরা যে টাকাটা সঞ্চয় করেন, সেটা দেশে পাঠিয়ে দেন। যারা অল্প সময়ের জন্য অভিবাসী থাকেন, তারাই টাকাটা পাঠান! এর ফলে আমাদের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স-এর মাধ্যমে একটা বড় টাকা আসতো, সেটাও আটকে যেতে চলেছে।”
তবে এতে শুধু ভারতের সমস্যা হবে, তাই নয়। স্ট্র্যাটেজিক বিশেষজ্ঞ শুভাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ মাধ্যমে বলেন, “এইচ-ওয়ান বি ভিসা মূলত কর্মী নির্ভর। মার্কিন নীতির ফলে সে দেশের মানুষদের জন্য কাজের সুযোগ বাড়বে, এমনটা নয়। বরং তারা সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। ভারতীয় কর্মীদের দক্ষতার বিকল্প এখনই অ্যামেরিকা তৈরি করতে পারবে না। এই সুযোগে ওই সংস্থাগুলিকে আমাদের দেশে বা প্রতিবেশী অন্যান্য দেশে ডেকে আনতে হবে। এর ফলে আমাদের শিল্প সম্ভাবনা উন্নত হবে, কাজের সুযোগ বাড়বে।”
অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ী ডিডাব্লিউকে বলেন, “অ্যামেরিকা দয়া দাক্ষিণ্য করে আমাদের কর্মীদের তাদের দেশে নিয়ে যায় না। সুতরাং এতে আমাদের যেমন ক্ষতি হবে, তেমনি আমেরিকারও লাভ হবে না। আমার মনে হয় না এটা বেশি দিন চলবে। এটা আসলে ট্রাম্প করছেন আমাদের ভয় দেখানোর জন্য। আমাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীটা অনেক বড়, মেধাবী ছাত্ররা শুধু আমেরিকা কেন, অন্যান্য দেশেও যেতে পারেন। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ভালো করতে হবে। তাই এ নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত নই, এটা রেগে গিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের। এতে খুব একটা লাভ হবে না তার।”
ভারতের উপরে চাপ
একের পর এক সিদ্ধান্তে নয়াদিল্লিকে চাপের মুখে ফেলতে চাইছে ওয়াশিংটন।
সিনিয়র সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, “ট্রাম্প একেক সময় একেক রকম নিদান দিচ্ছেন। কোনটা স্থায়ী হবে বা কোনটা হবে না, এটা নিয়ে এখনই নির্দিষ্টভাবে কিছু বলার সময় আসেনি। তিনি নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছেন। যেমন শুল্ক নিয়ে তিনি নানা ধরনের কথা নানা সময়ে বলছেন। আলোচনা এখনো বন্ধ হয়নি, আলোচনা চলছে। আসলে তিনি এমনভাবে চাপ তৈরি করতে চাইছেন, যাতে তার মনের মতো করে ভারত সমাধানে এগিয়ে আসে।”
রাজাগোপাল বলেন, “৮৭-১০০ বিলিয়ন ডলার আমরা আমেরিকায় রফতানি করতাম। সেটার উপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক বসে যাওয়ায় সেটাও বাধা প্রাপ্ত হচ্ছে। এখন ট্রাম্প ভারতকে ভাতে মারতে চাইছেন। ভারতের কাছে এটা একটা সুযোগ বলে ধরা যেতে পারে। সাধারণ মানুষের করের টাকায় যে মেধা ভারতে তৈরি হয়ে বিদেশে চলে যেত, সেই ব্রেন ড্রেন আটকে তাদের দেশে রেখে একটা আন্তর্জাতিক বাজার গড়ে তুলতে হবে। এতে দেশের মধ্যেই একটা বিরাট অর্থনীতির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।”
শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনৈতিক দিক থেকেও নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে ট্রাম্পের নীতির ফলে। অ্যামেরিকার সাম্প্রতিক গতিবিধির পরে চীনে এসসিও বৈঠকে নয়াদিল্লি ও বেজিং কাছাকাছি এসেছে। ট্রাম্পের চোখ রাঙানির বিপরীতে রাশিয়াকেও মিত্র হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারত-রাশিয়া-চীনের ঘনিষ্ঠতা কি অ্যামেরিকার প্রতি জবাব হতে পারে?
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ভারতের সঙ্গে অ্যামেরিকার সম্পর্ক গত ২০ বছরে ভালোর দিকে এগিয়েছে। তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কতটা কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠার মতো নজির চীন রাখতে পারেনি। ১৯৬২ সালে হিন্দি চিনি ভাই ভাই এর সময়ে তারা ভারত আক্রমণ করেছিল, চীনা প্রেসিডেন্ট নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দোলনায় দোল খাওয়ার পরে গালওয়ানের ঘটনা ঘটেছিল। পাঁচ বছরে সেই সীমান্ত বিরোধ মেটেনি। চীন বার বার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছে যে তারা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”