দুর্ঘটনা ও আশঙ্কার শুরু
নেপালের অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প থেকে নামার পথে সিঙ্গাপুরের স্যাম রবার্টস (৫৪) পা পিছলে পড়ে বাম পায়ে আঘাত পান। এ সময় তার ছোট ছেলে পাশে ছিল। অন্যদিকে তার স্ত্রী আন্না ইয়ো (৫২), সিঙ্গাপুরের একজন আইটি পেশাজীবী, কাঠমান্ডুর হাসপাতালে এক সপ্তাহ দুশ্চিন্তা ও নিদ্রাহীনতার পর অবশেষে স্বামীকে জড়িয়ে ধরেন।
ভ্রমণের পরিকল্পনা ভেঙে যায়
৪ সেপ্টেম্বর চার সদস্যের পরিবারটি সিঙ্গাপুর থেকে নেপালে যায়। উদ্দেশ্য ছিল দুই সপ্তাহের এক অভিযাত্রা, যেখানে দুই ছেলেকে (বয়স ১৫ ও ১৭) অন্নপূর্ণা ট্রেকের অভিজ্ঞতা দেওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অর্থ সংগ্রহও ছিল লক্ষ্য।
তবে ইয়ো নিজে হাঁটার সঙ্গে যোগ দিতে পারেননি পুরোনো চোটের কারণে। তিনি বন্ধু নিয়ে পোখারায় সময় কাটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। ভ্রমণ শেষে মুম্বাইয়ে ভাতিজার বিয়েতে যোগ দিয়ে গোয়ায় ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা ছিল পরিবারের। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়।
নেপালে সহিংস বিক্ষোভ
৮ সেপ্টেম্বর নেপালে ভয়াবহ সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। পরদিন ইয়ো পোখারার এক ক্যাফেতে বসে ছিলেন, হঠাৎ কুকুরগুলো ছুটে বেরিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর শতাধিক বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে ক্যাফের কর্মীরা শাটার নামিয়ে দেয়। পরে হোটেলে ফিরে ইয়ো এবং তার বন্ধু দেখেন সহিংসতা আরও বাড়ছে। সন্ধ্যায় পাশের ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ইয়ো উপলব্ধি করেন—তারা নিরাপদ নন।
হোটেলে বন্দি দিনগুলো
পাঁচ দিন ধরে হোটেল থেকে বের হতে পারেননি ইয়ো। সেনাবাহিনী দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে। এদিকে অন্নপূর্ণার ৪,১৩০ মিটার উচ্চতায় রবার্টস ও তার দুই ছেলে দুর্বল নেটওয়ার্কে স্ত্রীর পরিস্থিতি জানতে পারছিলেন না।
পাহাড়ে দুর্ঘটনা
হেলিকপ্টারে নামার পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও কোম্পানির ধর্মঘটের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বৃষ্টির মধ্যে নেমে আসতে গিয়ে রবার্টস পা পিছলে পড়েন ও গুরুতর আহত হন। তিনি এবং ছোট ছেলে ডেভিড পাহাড়ের এক আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে যান। বড় ছেলে ক্যালেব ও দলের অন্যরা নেমে আসতে বাধ্য হয়।
বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সহায়তা
এই সময় ইয়ো এবং রবার্টস সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতের সিঙ্গাপুর হাইকমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া ও মেঘের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যর্থ হতে থাকে। ইয়ো আশাহত হয়ে পড়লেও চেষ্টা করেছেন ইতিবাচক থাকার।
অবশেষে উদ্ধার
১৭ সেপ্টেম্বর আবহাওয়া পরিষ্কার হলে হেলিকপ্টার রবার্টস ও ডেভিডকে উদ্ধার করে কাঠমান্ডুতে নিয়ে যায়। বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে তাদের তুলে আনা হয় এবং সেখানে পরিবারের পুনর্মিলন ঘটে। রবার্টস বলেন, “১১ বছরের অভিজ্ঞতায় একজন পাইলট বললেন তিনি কখনও কাউকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পাহাড়ে ফেলে রাখেননি। আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম।”
দেশে ফেরার যাত্রা
১৯ সেপ্টেম্বর রবার্টস হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান। সরাসরি সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট না থাকায় পরিবারটি বেঙ্গালুরু যায় আত্মীয়দের কাছে। মুম্বাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান মিস হলেও বেঙ্গালুরুতে আলাদা সংবর্ধনায় উপস্থিত হয়ে সবাইকে অবাক করেন। ২০ সেপ্টেম্বর রাতে তারা বিমানে ওঠেন এবং ২১ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে পৌঁছান।
অভিজ্ঞতার শিক্ষা
পুরো অভিজ্ঞতা নিয়ে ইয়ো বলেন, “এটা আমাকে শিখিয়েছে আমরা আমাদের ব্যস্ত জীবনের উপরে কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাই। কিন্তু এখানে কিছুই আমাদের হাতে ছিল না। আমাদের ধৈর্য ধরতে হয়েছে এবং সময়ের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।”