ক্যালিফোর্নিয়ায় নতুন পরীক্ষার সূচনা
ক্যালিফোর্নিয়ার সোনোমা কাউন্টিতে নর্থ আমেরিকান প্রেসের মালিক ম্যাট নিয়েস প্রচলিত পথের বাইরে গিয়ে হাইব্রিড আঙুর চাষে মনোযোগ দিচ্ছেন। এই আঙুরগুলো ইউরোপীয় ভিনিফেরা প্রজাতি ও উত্তর আমেরিকার দেশীয় আঙুরের সংমিশ্রণ। যেখানে ক্যালিফোর্নিয়া মূলত ক্যাবারনে স্যাভিনিওন, চার্ডনে ও পিনট নয়ারের জন্য বিখ্যাত, সেখানে নিয়েসের এই উদ্যোগ শুরুতে তুচ্ছ মনে হলেও এখন বিশ্বজুড়ে হাইব্রিড আঙুর নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্বব্যাপী ওয়াইন উৎপাদন অঞ্চলগুলো দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা খাচ্ছে। উষ্ণায়নের পাশাপাশি খরা, শিলাবৃষ্টি, বসন্তকালীন তুষারপাত, ফাঙ্গাল রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ বেড়ে গেছে। ভিনিফেরা আঙুর এসব রোগের কাছে খুবই দুর্বল, ফলে কৃষকদের অনেক সময় বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। হাইব্রিড আঙুর তুলনামূলকভাবে এসবের বিরুদ্ধে বেশি প্রতিরোধী এবং রাসায়নিকের উপর নির্ভরশীলতা কমায়।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের টান
নিয়েস শুধু জলবায়ুর কারণেই নয়, আমেরিকার আঙুর প্রজাতি ও কৃষি ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ববোধ থেকেও কাজ করছেন। তিনি মনে করেন, উত্তর আমেরিকার স্থানীয় আঙুরকে কাজে লাগানো সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের অংশ।
ইউরোপ ও বিশ্বে পরীক্ষা
ফ্রান্স, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ভার্জিনিয়া, ভেরমন্ট ও কানাডার মতো অঞ্চলেও কৃষকরা হাইব্রিড আঙুরের দিকে ঝুঁকছেন। এমনকি ঐতিহাসিক ওয়াইন অঞ্চল শ্যাম্পেন ও বারগান্ডিতেও জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে হাইব্রিড আঙুরের ছোট পরিসরে পরীক্ষা চলছে।
- • ফ্রান্সের বোজোলেতে পিয়ের কটন ও মারিন বোনে দুটি হাইব্রিড আঙুর দিয়ে রোজে তৈরি করছেন।
- • পর্তুগালের আজোরেস ওয়াইন কোম্পানি ইসাবেলা আঙুর দিয়ে লাল ওয়াইন বানাচ্ছে।
- • জুরার ভ্যালেন্টিন মোরেল ও জার্মানির 2Naturkinder ও হাইব্রিড আঙুর থেকে সফল ওয়াইন তৈরি করছেন।
সান ফ্রান্সিসকোর উদ্যোগ
ক্রিস্টোফার রেনফ্রো আলেমানি ফার্মে পিনট নয়ার আঙুরের পরিবর্তে হাইব্রিড প্রজাতি লাগানোর পরিকল্পনা করছেন। তিনি বলছেন, এগুলোতে পাউডারি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রয়েছে, যা বড় সুবিধা।
দীর্ঘদিনের বদনাম ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
বহু বছর ধরে হাইব্রিড আঙুর থেকে তৈরি ওয়াইনকে তুচ্ছ, নিম্নমানের বা সস্তা বলে ধরা হতো। এর একটি কারণ হলো এগুলোকে সাধারণত যত্ন ছাড়াই চাষ করা হতো এবং নিম্নমানের ওয়াইনে ব্যবহার করা হতো। ১৯শ শতকে ইউরোপে পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে হাইব্রিড আঙুর ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায় এগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ২০২১ সালে জলবায়ু সংকটের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আংশিকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
ভেরমন্টের লা গ্যারাজিস্তার সাফল্য
যুক্তরাষ্ট্রে হাইব্রিড আঙুরের জনপ্রিয়তার পেছনে অন্যতম প্রেরণা ভেরমন্টের লা গ্যারাজিস্তা এস্টেট। ডিয়ারড্রে হিকিন ও ক্যালেব বারবার প্রতিষ্ঠিত এই খামারে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ঠান্ডা সহনশীল আঙুর প্রজাতি লাগানো হয়। তাদের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, ভিনিফেরা আঙুর টিকতে না পারলেও হাইব্রিড আঙুর সফলভাবে বেড়ে উঠতে পারে। হিকিন বলেন, তিনি স্থানীয় পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম আঙুর চাষ করতে চান।
অর্গানিক চাষ ও ভার্জিনিয়ার প্রচেষ্টা
ভার্জিনিয়ায় আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে ভিনিফেরা আঙুরে প্রাকৃতিকভাবে অর্গানিক চাষ প্রায় অসম্ভব। তাই কমন ওয়েলথ ক্রাশ কোম্পানির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো হাইব্রিড আঙুর ব্যবহার করছে। ভাই বেন ও টিম জর্ডান এবং লি ক্যাম্পবেল মিলে এই প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা স্থানীয় জলবায়ুর সাথে মানানসই নতুন রোগ-প্রতিরোধী আঙুরের জাত উদ্ভাবনে গবেষকদের সাথে কাজ করছেন।
ভবিষ্যতের আঙুর ও নতুন নামকরণ
বেন জর্ডান মনে করেন, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে ভার্জিনিয়ার জন্য বিশেষভাবে তৈরি আঙুর পাওয়া যাবে। তিনি “হাইব্রিড” শব্দের পরিবর্তে “রোগ-প্রতিরোধী” শব্দটি ব্যবহার করতে চান, কারণ এটি নেতিবাচক ধারণা এড়িয়ে বাস্তব সমস্যাকে প্রতিফলিত করে।
সোনোমার লক্ষ্য
ম্যাট নিয়েস এমন আঙুর খুঁজছেন যেগুলো দীর্ঘ মৌসুমে ভালো হয়, রোগ প্রতিরোধী এবং সেচ ছাড়াই বেড়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, “এমন আঙুর আছে যেগুলোতে কোনো স্প্রে দেওয়ার দরকার নেই, শ্রম কম লাগে—এটাই টেকসই কৃষির আদর্শ।”
সীমাবদ্ধতা ও সতর্কবার্তা
তবে ডিয়ারড্রে হিকিন সতর্ক করে বলেন, হাইব্রিড আঙুর সব সমস্যার সমাধান নয়। এগুলো অনেক কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হলেও চাষাবাদের পদ্ধতির উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন কৃষকদের প্রচলিত অভিজ্ঞতাকে বদলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “আগে যে পদ্ধতি কাজে লাগত, এখন আর ততটা কার্যকর নয়। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের শিখিয়েছে, সবসময় নতুনভাবে ভাবতে হয়। এখন টিকে থাকার একমাত্র উপায় হলো পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো।”