বাংলাদেশের জনপ্রিয় টেলিভিশন তারকা জিয়াউল ফারুক অপূর্ব জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮০ সালের ২৭ জুন ঢাকায়। তার শৈশব কেটেছে শিল্প ও সংস্কৃতিমণ্ডিত পরিবেশে। মা ফিরোজা আহমেদ রাজশাহী বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আর নানীও ছিলেন একই প্রতিষ্ঠানের উপস্থাপিকা। পরিবারের এই সাংস্কৃতিক পটভূমিই তাকে ছোটবেলা থেকেই শিল্প ও অভিনয়ের প্রতি টান তৈরি করে।
শিক্ষাজীবন ও প্রাথমিক আগ্রহ
অপূর্বের শিক্ষাজীবনের সূচনা ঢাকায় হলেও তার মূল আগ্রহ ছিল সৃজনশীল কাজে। পড়াশোনার পাশাপাশি নাটক, গান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। তরুণ বয়সে মডেলিং এবং অভিনয়ের প্রতি আকর্ষণ থেকেই ধীরে ধীরে মিডিয়ায় যুক্ত হওয়ার পথ তৈরি হয়।
বিনোদন জগতে প্রবেশ
২০০৪ সালে তিনি অংশ নেন ট্যালেন্ট হান্ট শো You Got the Looks-এ এবং সেখানে “Mr. Bangladesh” খেতাব অর্জন করেন। এই পুরস্কারই ছিল তার মূল ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। এরপর তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে কাজ করতে শুরু করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো নেসকাফে-র বিজ্ঞাপন, যেটি নির্মাণ করেছিলেন পরিচালক আমিতাভ রেজা চৌধুরী। এ বিজ্ঞাপনটি তাকে দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তোলে।
নাট্যজগতে ক্যারিয়ার
অপূর্বের নাটকে অভিষেক হয় ২০০৬ সালে গাজী রাকায়েত পরিচালিত ‘বৈবাহিক’ নাটকের মাধ্যমে। এরপর ধীরে ধীরে তিনি একের পর এক নাটকে অভিনয় করে দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রেম, আবেগ ও পারিবারিক গল্পে ভরা নাটকগুলোতে তার অভিনয় দর্শককে সহজেই স্পর্শ করত। টেলিভিশন নাটকে ধারাবাহিকভাবে কাজ করায় তিনি একসময় ঘরে ঘরে পরিচিত মুখে পরিণত হন।
প্রযোজনা ও পরিচালনা
শুধু অভিনয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি অপূর্ব। নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ASI Creations Limited গড়ে তোলেন। ২০১২ সালে তিনি ‘Backdated’ নামের একটি টেলিফিল্ম নির্মাণের মাধ্যমে পরিচালনায় অভিষেক করেন। এতে বোঝা যায় তিনি শুধু অভিনেতা নন, বরং সৃজনশীলতার ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়েও সমান আগ্রহী।
চলচ্চিত্র ও ওয়েবমাধ্যমে কাজ
২০১৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’-এ তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। যদিও তিনি মূলত টেলিভিশন নাটকে ব্যস্ত ছিলেন, তবে বড় পর্দায়ও তার উপস্থিতি দর্শকদের দৃষ্টি কেড়েছিল।
পরে ওয়েব মাধ্যমেও তিনি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মায়াশালিক’ (২০২২), যেখানে তার বিপরীতে ছিলেন সাদিয়া আইমান। এছাড়া ওয়েব সিরিজ ‘বুকের মধ্যে আগুন’-এ তিনি অভিনয় করেন এএসপি গোলাম মামুন চরিত্রে।
ব্যক্তিজীবন
অপূর্বের ব্যক্তিজীবন অনেক সময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে।
- • ২০১০ সালের আগস্টে তিনি অভিনেত্রীসাদিয়া জাহান প্রভাকে বিয়ে করেন, তবে কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় (ডিভোর্স: ফেব্রুয়ারি ২০১১)।
- • একই বছরের ডিসেম্বরে তিনি বিয়ে করেননাজিয়া হাসান অদিতিকে। তবে এ সম্পর্কও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; ২০২০ সালের মে মাসে তাদের বিচ্ছেদ ঘটে।
- • ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেনত্রিশা দেওয়ানকে।
- • অপূর্বের এক ছেলে আছে,নাম জায়্যান ফারুক আয়্যাশ।
অসুস্থতা ও জীবনের সংগ্রাম
২০২০ সালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অপূর্ব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয় এবং প্লাজমা থেরাপি দেওয়া হয়। সেই সময় তার সুস্থতা নিয়ে ভক্তরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং সামাজিক মাধ্যমে ভক্তদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেন।
অভিনয়শৈলী ও জনপ্রিয়তা
অপূর্বের অভিনয়ের মূল বৈশিষ্ট্য হলো আবেগঘন ও রোমান্টিক চরিত্রে অসাধারণ দক্ষতা। তার চেহারার আকর্ষণ, সংলাপ বলার ভঙ্গি এবং স্বাভাবিক অভিনয় তাকে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে।
তিনি বহুবার দর্শক জরিপভিত্তিক পুরস্কার জিতেছেন। এর মধ্যে রয়েছে –
- • মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১৮ (জনপ্রিয় অভিনেতা)
- • ATN Banglaপারফরম্যান্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৭
- • আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০২০
চ্যালেঞ্জ ও বিতর্ক
অপূর্বের জীবনে যেমন সাফল্য এসেছে, তেমনি এসেছে বিতর্কও। বিশেষ করে প্রথম স্ত্রী প্রভাকে ঘিরে ঘটে যাওয়া কেলেঙ্কারির কারণে তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। তবে সময়ের সাথে তিনি নিজের কাজের মাধ্যমে আবারও জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হন।
উত্তরাধিকার ও অনুপ্রেরণা
অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনা ও পরিচালনায় যুক্ত হয়ে অপূর্ব দেখিয়েছেন তার বহুমুখী প্রতিভা। টেলিভিশন নাটক থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে তার যাত্রা বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
আজও তিনি নতুন প্রজন্মের অভিনয়শিল্পীদের জন্য রোল মডেল এবং দর্শকদের জন্য প্রিয় নায়ক।