আট দশক পূর্তির প্রাক্কালে জাতিসংঘ এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।
সাধারণ পরিষদের উচ্চপর্যায়ের অধিবেশনের সপ্তাহজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রস্থল ছিল ফিলিস্তিন ও গাজা যুদ্ধ। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতিসংঘ ব্যর্থ। সত্যি বলতে, গাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে জাতিসংঘের অচলাবস্থার পেছনে বড় শক্তিগুলোর ভূমিকা বড়; তবু যুদ্ধ ও শান্তি–সংক্রান্ত প্রশ্নে জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা এবং সক্রিয় কূটনীতির অনুপস্থিতি এর সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বারবার সতর্ক করেছেন—ক্ষীয়মাণ বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি; বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার বন্ধন ভাঙনের মুখে। তাঁর কথায়, মানুষ “ভাঙা প্রতিশ্রুতি, অপূর্ণ অঙ্গীকার, দ্বৈত মানদণ্ড ও বিপুল বৈষম্য” দেখে বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস হারাচ্ছে।
বহুপাক্ষিকতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চাপের মুখে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ এ প্রবণতাকে গতিশীল করেছে এবং চাপ বাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা, ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে অর্থায়ন বন্ধ ও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত—সব মিলিয়ে জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। ট্রাম্পের একতরফা পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদের নীতির প্রতিও অবজ্ঞা দেখিয়েছে।

অন্যান্য বড় রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে নিজেদের মতো করে কাজ করে এ চিত্রকে গভীর করেছে। সাবেক মহাসচিব বান কি–মুন ও হেলেন ক্লার্কের সহ–লিখিত সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “কিছু ঐতিহ্যগত পৃষ্ঠপোষক—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র—যখন বহুপাক্ষিক সহযোগিতা থেকে সরে আসে, অর্থ কেটে দেয় এবং সুবিধামতো আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে, জাতিসংঘ তখন ক্রমে অকার্যকরতায় পা বাড়ায়।”
জাতিসংঘের অকার্যকারিতার কেন্দ্রে রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা।
উচ্চপর্যায়ের সপ্তাহে এই বৈপরীত্য প্রবলভাবে ধরা পড়ে। বিতর্কের সূচনায় গুতেরেস বলেন, বিশ্বের জাতিসংঘকে দরকার তার “অদ্বিতীয় বৈধতা” ও সমাবেশী শক্তির জন্য। প্রত্যাশামতো, ট্রাম্প জাতিসংঘ সম্পর্কে তাঁর চেনা অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে কথা বলেন; বিভিন্ন ইস্যুতে সংস্থাটিকে আক্রমণ করেন এবং ভুলভাবে অভিযোগ তোলেন যে, জাতিসংঘ নাকি অভিবাসীদের অর্থায়ন করে পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘আক্রমণ’ চালাতে সহায়তা করছে।
এর ঠিক আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছিলেন, বহুপাক্ষিকতা নতুন এক সন্ধিক্ষণে—জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতাদের অনুপ্রেরণামূলক আদর্শ আজ অভূতপূর্ব হুমকির মুখে। তিনি জাতিসংঘের কর্তৃত্ব ক্ষয়ের বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে সংস্থাটিকে “সমতা, শান্তি, টেকসই উন্নয়ন, বৈচিত্র্য ও সহনশীলতার” প্রবক্তা হিসেবে আবারও ভূমিকা জোরদারের আহ্বান জানান।
আলোচনাগুলোর সাধারণ সুর ছিল—সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের সময় জাতিসংঘ অকার্যকর। অনেক নেতা কিছু রাষ্ট্রের একতরফা পদক্ষেপের নিন্দা করেন এবং বহুপাক্ষিকতা শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাঁরা জাতিসংঘকে তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

বক্তৃতার বাইরে, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্যাপক ধারণা হলো—যুদ্ধ ও সংকটে জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকায় অবনত হওয়ায় সংস্থাটি ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল লক্ষ্য পূরণে যদি জাতিসংঘ ব্যর্থ—তবে তার অন্যান্য কাজ (এর কিছু খুবই ভালো—উন্নয়ন এজেন্ডা ও মানবিক উদ্যোগের কথা বলা যায়) গৌণ হয়ে যায়। শান্তি–নিরাপত্তার স্তম্ভেই সরকার ও জনগণ জাতিসংঘকে বিচার করে—এবং এ ক্ষেত্রেই সংস্থাটিকে ‘উপযোগী’ বলে মনে হচ্ছে না।
এ দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদের; কিন্তু পাঁচ স্থায়ী সদস্যের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভেটো–রাজনীতি পরিষদকে কার্যত পঙ্গু করে রেখেছে। বর্তমান সময়ের দুই প্রধান যুদ্ধ—গাজা ও ইউক্রেন—এর চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ আর নেই।
ইসরায়েল আরোপিত গাজা যুদ্ধ বন্ধে মূল বাধা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র; গত দুই বছরে তারা ছয়বার ভেটো দিয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ঠেকিয়েছে। এ ধারাবাহিকতা নতুন নয়—দশকের পর দশক ধরে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে রক্ষায় ৫১ বার ভেটো ব্যবহার করেছে। ইউক্রেন প্রসঙ্গে ২০২২ সালের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রস্তাবে রাশিয়া বারবার ভেটো দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে আছে।
বর্ধমান সমালোচনা ও অর্থ সংকটের প্রেক্ষাপটে মহাসচিব ‘জাতিসংঘ ৮০’ সংস্কার উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন এবং শান্তি–নিরাপত্তা খাতে পূর্ববর্তী সংস্কারের উপর ভিত্তি করে এ উদ্যোগের লক্ষ্য ম্যান্ডেট সরলীকরণ এবং জাতিসংঘকে আরও সাশ্রয়ী ও দক্ষ করে তোলা। কিন্তু এতে বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম।
অর্থসংকট–চালিত এসব সংস্কার রাজনৈতিক বিবেচনায় “অদক্ষ” আখ্যা দিয়ে কিছু ম্যান্ডেট বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে—বড় শক্তিগুলোর অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটিয়ে। ফলে সংস্কার–প্রক্রিয়া নিজেই বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠবে।

যা সত্যিকার অর্থে জাতিসংঘের কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে জড়িত, তা হলো নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। জাতিসংঘের অকার্যকারিতার হৃদয়ে আছে পরিষদের অচলাবস্থা। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বনেতারা প্রতি বারের মতো এবারও সংস্কারের ডাক দিয়েছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে আলোচনা–বিনিময় চলছে; অগ্রগতি বলতে মূলত পরিষদ সম্প্রসারণে নীতিগত সম্মতি। কিন্তু ভেটো প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ রয়ে গেছে।
মূল বিরোধ একদিকে স্থায়ী আসনের দাবিদার দেশগুলো, অন্যদিকে স্থায়ী সদস্য না বাড়িয়ে নির্বাচিত অস্থায়ী সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবদাতাদের মধ্যে। এতে জার্মানি–জাপান–ভারত–ব্রাজিলের জোট (জি–ফোর) মুখোমুখি হয়েছে ইতালির নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস’ গোষ্ঠীর, যার মধ্যে পাকিস্তানও আছে।
‘ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস’–এর যুক্তি—নির্বাচিত সদস্য যোগ করে পরিষদকে আরও প্রতিনিধিত্বশীল, জবাবদিহিমূলক ও কার্যকর করা উচিত, যাতে ভেটো–সক্ষম পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হয়। তাদের মতে, পরিষদের দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার কারণ স্থায়ী সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও স্বার্থসংঘাত; আরও ভেটো–সক্ষম স্থায়ী সদস্য যোগ করলে অকার্যকারিতা কমবে না, বরং বাড়বে।
ধরা যাক অচলাবস্থা কাটল; তবু সংস্কার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল—কারণ এতে জাতিসংঘ সনদ সংশোধন করতে হবে। প্রথমে সাধারণ পরিষদে দুই–তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব পাস, তারপর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের অন্তত দুই–তৃতীয়াংশের অনুসমর্থন এবং সঙ্গে স্থায়ী পাঁচ সদস্যেরও অনুসমর্থন—সবকিছু মিলিয়ে সংস্কার এখনো দূরাস্ত। বড় শক্তিগুলোকে চাপ দেওয়া এবং পরিষদকে কার্যকর করতে বাধ্য করা—এ দায়িত্ব সাধারণ পরিষদের; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এ সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত
মালিহা লোধি 



















