০৩:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
“আরও গভীর পরিসংখ্যান নিয়ে ফিরলো অ্যাপল মিউজিক ‘রিপ্লে ২০২৫’” “মিইয়ে যাওয়া জিডিপি সংখ্যার আড়ালে অস্ট্রেলিয়ার চাহিদা এখনো ‘গরম’” “নতুন নোভা এআই মডেল উন্মোচনে করপোরেট গ্রাহকদের মন জয়ে ঝুঁকল এডব্লিউএস” “মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডের আঘাতে বিধ্বস্ত হংকং, তবু সামনে ‘দেশপ্রেমিকদের’ নির্বাচন” চাকরি হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ হোয়াইট হাউসের শোভা: ছুটির মৌসুমে ‘ঘর’ সাজানো ধনী আমেরিকানরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য দায়ী নারী নিহত, ভাতিজি আহত: জয়পুরহাটে দুর্বৃত্তদের হামলা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দীর মৃত্যু গাজীপুরে কারখানার দূষিত পানি পানে অসুস্থ তিন শতাধিক শ্রমিক

জাতিসংঘের জন্মদিনের বিষণ্নতা

আট দশক পূর্তির প্রাক্কালে জাতিসংঘ এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেযেখানে সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।

সাধারণ পরিষদের উচ্চপর্যায়ের অধিবেশনের সপ্তাহজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রস্থল ছিল ফিলিস্তিন ও গাজা যুদ্ধ। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছেআন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতিসংঘ ব্যর্থ। সত্যি বলতেগাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে জাতিসংঘের অচলাবস্থার পেছনে বড় শক্তিগুলোর ভূমিকা বড়তবু যুদ্ধ ও শান্তিসংক্রান্ত প্রশ্নে জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা এবং সক্রিয় কূটনীতির অনুপস্থিতি এর সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বারবার সতর্ক করেছেনক্ষীয়মাণ বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরিবৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার বন্ধন ভাঙনের মুখে। তাঁর কথায়মানুষ ভাঙা প্রতিশ্রুতিঅপূর্ণ অঙ্গীকারদ্বৈত মানদণ্ড ও বিপুল বৈষম্য” দেখে বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস হারাচ্ছে।

বহুপাক্ষিকতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চাপের মুখে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ এ প্রবণতাকে গতিশীল করেছে এবং চাপ বাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাজাতিসংঘ শিক্ষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থাফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে অর্থায়ন বন্ধ ও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তসব মিলিয়ে জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। ট্রাম্পের একতরফা পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদের নীতির প্রতিও অবজ্ঞা দেখিয়েছে।

80th Birthday Blues: UN's Fight to Stay Relevant | Chicago Council on Global Affairs

অন্যান্য বড় রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে নিজেদের মতো করে কাজ করে এ চিত্রকে গভীর করেছে। সাবেক মহাসচিব বান কিমুন ও হেলেন ক্লার্কের সহলিখিত সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “কিছু ঐতিহ্যগত পৃষ্ঠপোষকবিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রযখন বহুপাক্ষিক সহযোগিতা থেকে সরে আসেঅর্থ কেটে দেয় এবং সুবিধামতো আইনের শাসনকে উপেক্ষা করেজাতিসংঘ তখন ক্রমে অকার্যকরতায় পা বাড়ায়।

জাতিসংঘের অকার্যকারিতার কেন্দ্রে রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা।

উচ্চপর্যায়ের সপ্তাহে এই বৈপরীত্য প্রবলভাবে ধরা পড়ে। বিতর্কের সূচনায় গুতেরেস বলেনবিশ্বের জাতিসংঘকে দরকার তার অদ্বিতীয় বৈধতা” ও সমাবেশী শক্তির জন্য। প্রত্যাশামতোট্রাম্প জাতিসংঘ সম্পর্কে তাঁর চেনা অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে কথা বলেনবিভিন্ন ইস্যুতে সংস্থাটিকে আক্রমণ করেন এবং ভুলভাবে অভিযোগ তোলেন যেজাতিসংঘ নাকি অভিবাসীদের অর্থায়ন করে পশ্চিমা দেশগুলোতে আক্রমণ’ চালাতে সহায়তা করছে।

এর ঠিক আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছিলেনবহুপাক্ষিকতা নতুন এক সন্ধিক্ষণেজাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতাদের অনুপ্রেরণামূলক আদর্শ আজ অভূতপূর্ব হুমকির মুখে। তিনি জাতিসংঘের কর্তৃত্ব ক্ষয়ের বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে সংস্থাটিকে সমতাশান্তিটেকসই উন্নয়নবৈচিত্র্য ও সহনশীলতার” প্রবক্তা হিসেবে আবারও ভূমিকা জোরদারের আহ্বান জানান।

আলোচনাগুলোর সাধারণ সুর ছিলসবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের সময় জাতিসংঘ অকার্যকর। অনেক নেতা কিছু রাষ্ট্রের একতরফা পদক্ষেপের নিন্দা করেন এবং বহুপাক্ষিকতা শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাঁরা জাতিসংঘকে তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

আজ জাতিসংঘ দিবস

বক্তৃতার বাইরেবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্যাপক ধারণা হলোযুদ্ধ ও সংকটে জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকায় অবনত হওয়ায় সংস্থাটি ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল লক্ষ্য পূরণে যদি জাতিসংঘ ব্যর্থতবে তার অন্যান্য কাজ (এর কিছু খুবই ভালোউন্নয়ন এজেন্ডা ও মানবিক উদ্যোগের কথা বলা যায়) গৌণ হয়ে যায়। শান্তিনিরাপত্তার স্তম্ভেই সরকার ও জনগণ জাতিসংঘকে বিচার করেএবং এ ক্ষেত্রেই সংস্থাটিকে উপযোগী’ বলে মনে হচ্ছে না।

এ দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদেরকিন্তু পাঁচ স্থায়ী সদস্যের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভেটোরাজনীতি পরিষদকে কার্যত পঙ্গু করে রেখেছে। বর্তমান সময়ের দুই প্রধান যুদ্ধগাজা ও ইউক্রেনএর চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ আর নেই।

ইসরায়েল আরোপিত গাজা যুদ্ধ বন্ধে মূল বাধা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রগত দুই বছরে তারা ছয়বার ভেটো দিয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ঠেকিয়েছে। এ ধারাবাহিকতা নতুন নয়দশকের পর দশক ধরে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে রক্ষায় ৫১ বার ভেটো ব্যবহার করেছে। ইউক্রেন প্রসঙ্গে ২০২২ সালের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রস্তাবে রাশিয়া বারবার ভেটো দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে আছে।

বর্ধমান সমালোচনা ও অর্থ সংকটের প্রেক্ষাপটে মহাসচিব জাতিসংঘ ৮০’ সংস্কার উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনাউন্নয়ন এবং শান্তিনিরাপত্তা খাতে পূর্ববর্তী সংস্কারের উপর ভিত্তি করে এ উদ্যোগের লক্ষ্য ম্যান্ডেট সরলীকরণ এবং জাতিসংঘকে আরও সাশ্রয়ী ও দক্ষ করে তোলা। কিন্তু এতে বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম।

অর্থসংকটচালিত এসব সংস্কার রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষ” আখ্যা দিয়ে কিছু ম্যান্ডেট বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারেবড় শক্তিগুলোর অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটিয়ে। ফলে সংস্কারপ্রক্রিয়া নিজেই বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠবে।

United Nations Flags, Flags of the United Nations, Chart, UN Poster, United Nations, United Nations

যা সত্যিকার অর্থে জাতিসংঘের কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে জড়িততা হলো নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। জাতিসংঘের অকার্যকারিতার হৃদয়ে আছে পরিষদের অচলাবস্থা। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বনেতারা প্রতি বারের মতো এবারও সংস্কারের ডাক দিয়েছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে আলোচনাবিনিময় চলছেঅগ্রগতি বলতে মূলত পরিষদ সম্প্রসারণে নীতিগত সম্মতি। কিন্তু ভেটো প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ রয়ে গেছে।

মূল বিরোধ একদিকে স্থায়ী আসনের দাবিদার দেশগুলোঅন্যদিকে স্থায়ী সদস্য না বাড়িয়ে নির্বাচিত অস্থায়ী সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবদাতাদের মধ্যে। এতে জার্মানিজাপানভারতব্রাজিলের জোট (জিফোর) মুখোমুখি হয়েছে ইতালির নেতৃত্বাধীন ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস’ গোষ্ঠীরযার মধ্যে পাকিস্তানও আছে।

ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস’–এর যুক্তিনির্বাচিত সদস্য যোগ করে পরিষদকে আরও প্রতিনিধিত্বশীলজবাবদিহিমূলক ও কার্যকর করা উচিতযাতে ভেটোসক্ষম পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হয়। তাদের মতেপরিষদের দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার কারণ স্থায়ী সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও স্বার্থসংঘাতআরও ভেটোসক্ষম স্থায়ী সদস্য যোগ করলে অকার্যকারিতা কমবে নাবরং বাড়বে।

ধরা যাক অচলাবস্থা কাটলতবু সংস্কার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিলকারণ এতে জাতিসংঘ সনদ সংশোধন করতে হবে। প্রথমে সাধারণ পরিষদে দুইতৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব পাসতারপর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের অন্তত দুইতৃতীয়াংশের অনুসমর্থন এবং সঙ্গে স্থায়ী পাঁচ সদস্যেরও অনুসমর্থনসবকিছু মিলিয়ে সংস্কার এখনো দূরাস্ত। বড় শক্তিগুলোকে চাপ দেওয়া এবং পরিষদকে কার্যকর করতে বাধ্য করাএ দায়িত্ব সাধারণ পরিষদেরকিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবেএ সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রযুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত

জনপ্রিয় সংবাদ

“আরও গভীর পরিসংখ্যান নিয়ে ফিরলো অ্যাপল মিউজিক ‘রিপ্লে ২০২৫’”

জাতিসংঘের জন্মদিনের বিষণ্নতা

০৮:০০:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আট দশক পূর্তির প্রাক্কালে জাতিসংঘ এমন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেযেখানে সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে।

সাধারণ পরিষদের উচ্চপর্যায়ের অধিবেশনের সপ্তাহজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রস্থল ছিল ফিলিস্তিন ও গাজা যুদ্ধ। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছেআন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে জাতিসংঘ ব্যর্থ। সত্যি বলতেগাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে জাতিসংঘের অচলাবস্থার পেছনে বড় শক্তিগুলোর ভূমিকা বড়তবু যুদ্ধ ও শান্তিসংক্রান্ত প্রশ্নে জাতিসংঘের নিষ্ক্রিয়তা এবং সক্রিয় কূটনীতির অনুপস্থিতি এর সুনামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বারবার সতর্ক করেছেনক্ষীয়মাণ বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত জরুরিবৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থার বন্ধন ভাঙনের মুখে। তাঁর কথায়মানুষ ভাঙা প্রতিশ্রুতিঅপূর্ণ অঙ্গীকারদ্বৈত মানদণ্ড ও বিপুল বৈষম্য” দেখে বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস হারাচ্ছে।

বহুপাক্ষিকতা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চাপের মুখে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণ এ প্রবণতাকে গতিশীল করেছে এবং চাপ বাড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাজাতিসংঘ শিক্ষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থাফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে অর্থায়ন বন্ধ ও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তসব মিলিয়ে জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। ট্রাম্পের একতরফা পদক্ষেপ জাতিসংঘ সনদের নীতির প্রতিও অবজ্ঞা দেখিয়েছে।

80th Birthday Blues: UN's Fight to Stay Relevant | Chicago Council on Global Affairs

অন্যান্য বড় রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোও আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে নিজেদের মতো করে কাজ করে এ চিত্রকে গভীর করেছে। সাবেক মহাসচিব বান কিমুন ও হেলেন ক্লার্কের সহলিখিত সাম্প্রতিক এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, “কিছু ঐতিহ্যগত পৃষ্ঠপোষকবিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রযখন বহুপাক্ষিক সহযোগিতা থেকে সরে আসেঅর্থ কেটে দেয় এবং সুবিধামতো আইনের শাসনকে উপেক্ষা করেজাতিসংঘ তখন ক্রমে অকার্যকরতায় পা বাড়ায়।

জাতিসংঘের অকার্যকারিতার কেন্দ্রে রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা।

উচ্চপর্যায়ের সপ্তাহে এই বৈপরীত্য প্রবলভাবে ধরা পড়ে। বিতর্কের সূচনায় গুতেরেস বলেনবিশ্বের জাতিসংঘকে দরকার তার অদ্বিতীয় বৈধতা” ও সমাবেশী শক্তির জন্য। প্রত্যাশামতোট্রাম্প জাতিসংঘ সম্পর্কে তাঁর চেনা অবজ্ঞাসূচক ভঙ্গিতে কথা বলেনবিভিন্ন ইস্যুতে সংস্থাটিকে আক্রমণ করেন এবং ভুলভাবে অভিযোগ তোলেন যেজাতিসংঘ নাকি অভিবাসীদের অর্থায়ন করে পশ্চিমা দেশগুলোতে আক্রমণ’ চালাতে সহায়তা করছে।

এর ঠিক আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা বলেছিলেনবহুপাক্ষিকতা নতুন এক সন্ধিক্ষণেজাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতাদের অনুপ্রেরণামূলক আদর্শ আজ অভূতপূর্ব হুমকির মুখে। তিনি জাতিসংঘের কর্তৃত্ব ক্ষয়ের বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে সংস্থাটিকে সমতাশান্তিটেকসই উন্নয়নবৈচিত্র্য ও সহনশীলতার” প্রবক্তা হিসেবে আবারও ভূমিকা জোরদারের আহ্বান জানান।

আলোচনাগুলোর সাধারণ সুর ছিলসবচেয়ে বেশি প্রয়োজনের সময় জাতিসংঘ অকার্যকর। অনেক নেতা কিছু রাষ্ট্রের একতরফা পদক্ষেপের নিন্দা করেন এবং বহুপাক্ষিকতা শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাঁরা জাতিসংঘকে তার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।

আজ জাতিসংঘ দিবস

বক্তৃতার বাইরেবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ব্যাপক ধারণা হলোযুদ্ধ ও সংকটে জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকায় অবনত হওয়ায় সংস্থাটি ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার মূল লক্ষ্য পূরণে যদি জাতিসংঘ ব্যর্থতবে তার অন্যান্য কাজ (এর কিছু খুবই ভালোউন্নয়ন এজেন্ডা ও মানবিক উদ্যোগের কথা বলা যায়) গৌণ হয়ে যায়। শান্তিনিরাপত্তার স্তম্ভেই সরকার ও জনগণ জাতিসংঘকে বিচার করেএবং এ ক্ষেত্রেই সংস্থাটিকে উপযোগী’ বলে মনে হচ্ছে না।

এ দায়িত্ব নিরাপত্তা পরিষদেরকিন্তু পাঁচ স্থায়ী সদস্যের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভেটোরাজনীতি পরিষদকে কার্যত পঙ্গু করে রেখেছে। বর্তমান সময়ের দুই প্রধান যুদ্ধগাজা ও ইউক্রেনএর চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ আর নেই।

ইসরায়েল আরোপিত গাজা যুদ্ধ বন্ধে মূল বাধা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রগত দুই বছরে তারা ছয়বার ভেটো দিয়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ঠেকিয়েছে। এ ধারাবাহিকতা নতুন নয়দশকের পর দশক ধরে ওয়াশিংটন ইসরায়েলকে রক্ষায় ৫১ বার ভেটো ব্যবহার করেছে। ইউক্রেন প্রসঙ্গে ২০২২ সালের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রস্তাবে রাশিয়া বারবার ভেটো দিয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিষদ সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে আছে।

বর্ধমান সমালোচনা ও অর্থ সংকটের প্রেক্ষাপটে মহাসচিব জাতিসংঘ ৮০’ সংস্কার উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন। ব্যবস্থাপনাউন্নয়ন এবং শান্তিনিরাপত্তা খাতে পূর্ববর্তী সংস্কারের উপর ভিত্তি করে এ উদ্যোগের লক্ষ্য ম্যান্ডেট সরলীকরণ এবং জাতিসংঘকে আরও সাশ্রয়ী ও দক্ষ করে তোলা। কিন্তু এতে বড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম।

অর্থসংকটচালিত এসব সংস্কার রাজনৈতিক বিবেচনায় অদক্ষ” আখ্যা দিয়ে কিছু ম্যান্ডেট বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারেবড় শক্তিগুলোর অগ্রাধিকারের প্রতিফলন ঘটিয়ে। ফলে সংস্কারপ্রক্রিয়া নিজেই বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠবে।

United Nations Flags, Flags of the United Nations, Chart, UN Poster, United Nations, United Nations

যা সত্যিকার অর্থে জাতিসংঘের কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে জড়িততা হলো নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। জাতিসংঘের অকার্যকারিতার হৃদয়ে আছে পরিষদের অচলাবস্থা। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বনেতারা প্রতি বারের মতো এবারও সংস্কারের ডাক দিয়েছেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ পরিষদে এ নিয়ে আলোচনাবিনিময় চলছেঅগ্রগতি বলতে মূলত পরিষদ সম্প্রসারণে নীতিগত সম্মতি। কিন্তু ভেটো প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ রয়ে গেছে।

মূল বিরোধ একদিকে স্থায়ী আসনের দাবিদার দেশগুলোঅন্যদিকে স্থায়ী সদস্য না বাড়িয়ে নির্বাচিত অস্থায়ী সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবদাতাদের মধ্যে। এতে জার্মানিজাপানভারতব্রাজিলের জোট (জিফোর) মুখোমুখি হয়েছে ইতালির নেতৃত্বাধীন ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস’ গোষ্ঠীরযার মধ্যে পাকিস্তানও আছে।

ইউনাইটিং ফর কনসেনসাস’–এর যুক্তিনির্বাচিত সদস্য যোগ করে পরিষদকে আরও প্রতিনিধিত্বশীলজবাবদিহিমূলক ও কার্যকর করা উচিতযাতে ভেটোসক্ষম পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হয়। তাদের মতেপরিষদের দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থার কারণ স্থায়ী সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও স্বার্থসংঘাতআরও ভেটোসক্ষম স্থায়ী সদস্য যোগ করলে অকার্যকারিতা কমবে নাবরং বাড়বে।

ধরা যাক অচলাবস্থা কাটলতবু সংস্কার প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিলকারণ এতে জাতিসংঘ সনদ সংশোধন করতে হবে। প্রথমে সাধারণ পরিষদে দুইতৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব পাসতারপর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের অন্তত দুইতৃতীয়াংশের অনুসমর্থন এবং সঙ্গে স্থায়ী পাঁচ সদস্যেরও অনুসমর্থনসবকিছু মিলিয়ে সংস্কার এখনো দূরাস্ত। বড় শক্তিগুলোকে চাপ দেওয়া এবং পরিষদকে কার্যকর করতে বাধ্য করাএ দায়িত্ব সাধারণ পরিষদেরকিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবেএ সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রযুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত