মেধাকেন্দ্রিকতা—অর্থাৎ প্রতিভা, পরিশ্রম ও সততার গুণে মানুষ এগিয়ে যাবে—দীর্ঘদিন ধরে যে কোনো সফল সমাজের আদর্শ ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে মেধা প্রায়ই পছন্দ-অপছন্দ, স্বজনপ্রীতি এবং গোপন লেনদেনের ভারে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এর ফল শুধু নিয়োগব্যবস্থার ভাঙন নয়; এটি পেশাজীবী, চিন্তক ও স্বপ্নবাজদের ওপর ছড়িয়ে পড়া এক জাতীয় হতাশা, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দমিয়ে রাখছে।
আমি এই লেখা লিখছি কোনো বিমূর্ত পর্যবেক্ষক হিসেবে নয়; বরং এমন একজন সাক্ষী—এবং অংশগ্রহণকারী—হিসেবে, যে বহুবার মেধাকেন্দ্রিকতার দাবিদার প্রক্রিয়ার ভেতর থেকেও দেখেছে, ক্ষমতা, রাজনীতি ও স্বার্থের চাপে সেই প্রক্রিয়া কীভাবে ভেঙে পড়ে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জানালা: স্টেট ব্যাংকের ঘটনাগুলো
২০০৮ সালে বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী রাজনৈতিক রূপান্তরের সময়ে ইউসুফ রেজা গিলানি প্রধানমন্ত্রী এবং আসিফ আলী জারদারি প্রেসিডেন্ট হন। এই ক্ষমতা-পুনর্বিন্যাসের মধ্যে পাকিস্তানের স্টেট ব্যাংক (এসবিপি) কয়েকটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়, যার মধ্যে মুখ্য মুখপাত্রের পদটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনেক সাংবাদিক ও যোগাযোগপেশাজীবীর মতো আমিও আবেদন করি। প্রতিযোগিতা ছিল কঠিন; দুই ডজনেরও বেশি অভিজ্ঞ প্রার্থী শর্টলিস্ট হন, যাদের সবারই মাঠপর্যায়ের দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। ঘোষণা ছিল পরিষ্কার: যোগ্যতম প্রার্থী বাছাইয়ে কঠোর, মেধাভিত্তিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
কিন্তু পাকিস্তানে যেমন প্রায়ই ঘটে, বাস্তবতা কথার সঙ্গে মেলেনি। নতুন কাউকে নিয়োগ না দিয়ে এসবিপি অবসরের দ্বারপ্রান্তে থাকা তৎকালীন মুখপাত্র ওয়াসিমুদ্দিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। সিদ্ধান্তটি হয়তো স্থিতাবস্থার পক্ষে ছিল, কিন্তু মেধাকেন্দ্রিকতার চেতনাকে ছিন্নভিন্ন করে। বার্তাটি ছিল স্পষ্ট: প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে “চেনা ও বিশ্বস্ত” মুখগুলোকেই বেশি মূল্য দেয়।
২০১৩-তে এসে দেখা যায়, নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন স্বচ্ছতা ও পরিবর্তনের স্লোগান নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসে। পত্রিকাজুড়ে তরুণ পেশাজীবীদের জন্য সুযোগের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়। আবারও এসবিপি মুখ্য মুখপাত্রের পদের জন্য আবেদন আহ্বান করে। এ বার ডজনখানেক প্রার্থী, অধিকাংশই গণমাধ্যম থেকে, সাক্ষাৎকার পর্যায়ে পৌঁছান।
কিন্তু প্রক্রিয়াটি ছিল নাটকের মতো—সারবত্তার চেয়ে অভিনয় বেশি। প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ডেপুটি গভর্নরসহ সাক্ষাৎকার বোর্ডের প্রশ্নে যোগাযোগবিদ্যার প্রতি এক অদ্ভুত সংকীর্ণ বোঝাপড়া ধরা পড়ে। এক সদস্য প্রশ্ন করলেন, “স্টেট ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে—এমন খবর আপনি কীভাবে থামাবেন?” আমি হতবাক। মুখপাত্রের কাজ কি তথ্য দমন করা—না কি ব্যাখ্যা ও স্পষ্টীকরণ?
আমি সোজাসাপটা বলি—আমার পদ্ধতি হবে সময়োচিত ও সক্রিয় যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান ও জনতার মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারসহ। বোর্ড সে প্রস্তাব উড়িয়ে দিল। এক সদস্য আমলাতান্ত্রিক দৃঢ়তায় বললেন, “আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থা; আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া দরকার নেই।” বিদ্রূপাত্মকভাবে কয়েক মাস পরই একই এসবিপি সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজির হলো, নতুন ওয়েবসাইটও চালু করল—কিন্তু বিজ্ঞাপনে আহ্বান করা প্রার্থীদের মধ্য থেকে কাউকেই নিয়োগ না দিয়ে। পদটি নীরবে অভ্যন্তরীণ বদলির মাধ্যমে পূরণ করা হলো।
আমার জন্য যন্ত্রণা শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়; ছিল উপলব্ধি—সমগ্র প্রক্রিয়াটাই এক প্রহসন। বিজ্ঞাপন, শর্টলিস্ট, সাক্ষাৎকার—সবই ছিল সাজসজ্জা; আড়ালে আগে থেকেই ঠিক করা সিদ্ধান্তগুলোকে “মেধা”র মোড়কে প্রদর্শনের আয়োজন।
বৃহত্তর সংকট: যখন প্রতিভা দেয়ালে ধাক্কা খায়
আমার গল্প হাজারো কণ্ঠের একটি মাত্র প্রতিধ্বনি। কোনো তরুণ স্নাতক, মধ্যপর্যায়ের কর্মী বা সিনিয়র বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন—একই নিরাশ সুর: “এখানে মেধার দাম নেই।”
সরকারি দপ্তরে ‘সিফারিশ’ (চেনাজানার যোগসূত্র) সিভির চেয়ে শক্তিশালী। করপোরেটে ব্যক্তিপ্রীতি কর্মদক্ষতাকে হার মানায়। একাডেমিয়ায় নিয়োগ অনেক সময় গবেষণা-অর্জনের চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতিফলন।
ভয়াবহ পরিণতি
মেধাপ্রবাহ-পলায়ন: প্রতিবছর হাজারো মেধাবী কানাডা, উপসাগরীয় দেশ, ইউরোপসহ নানা দেশে পাড়ি জমান। তারা দেশপ্রেমহীন বলে নয়; বরং এখানে তাদের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে সিস্টেম অপারগ বলে।
হতাশা: যারা থেকে যায়, “সংযোগসম্পন্ন” প্রার্থীদের পেছনে পড়ে থাকতে থাকতে আশা হারায়। তরুণ পেশাজীবীদের বিষণ্নতা আজ শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসমস্যা নয়—এটি এক জাতীয় ট্র্যাজেডি।
জড়তা: যে প্রতিষ্ঠান মেধাকে অস্বীকার করে, তা থমকে যায়। নতুন চিন্তা ও সক্ষম নেতৃত্ব ছাড়া সংগঠনগুলো মধ্যম মানকে রিসাইকেল করতে করতে দ্রুত বদলে যাওয়া পৃথিবীতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
বিশ্বাসক্ষয়: মানুষ কেবল প্রতিষ্ঠানেই আস্থা হারায় না; ন্যায্যতার ধারণাতেও আস্থা হারায়। যখন নিয়মই কারসাজিপূর্ণ মনে হয়, সংশয় বেড়ে যায়—আর সংশয় একবার শেকড় গাড়লে সামাজিক সংহতি ক্ষয়ে যায়।
মানবিক মূল্য: উপেক্ষিতদের গল্প
চাকরির বাজারে প্রবেশ করা তরুণীদের কথা ভাবুন। তাদের বাধা দ্বিগুণ। মেধাকেন্দ্রিকতা যেখানে আগেই নড়বড়ে, সেখানে সাংস্কৃতিক পক্ষপাত ও প্রাতিষ্ঠানিক নারীবিদ্বেষ সুযোগকে আরও সঙ্কুচিত করে। নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা এক তরুণীকে তার দক্ষতা নয়, বরং “পরিবার-চাকরি সামলানোর সক্ষমতা” নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কত মেধাবী নারী যে প্রবেশদ্বারেই নিরুৎসাহিত হয়ে পেশাজীবন শুরু করার আগেই স্বপ্ন গুটিয়ে নেন!
অথবা ভাবুন সেই মধ্যবিত্ত পেশাজীবীর কথা, যিনি বৃত্তিতে বিদেশে পড়ে উচ্চতর ডিগ্রি ও বিশ্বমানের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফেরেন। তাকে আপন করে নেওয়ার বদলে প্রায়ই পাশে সরিয়ে রাখা হয়—কম যোগ্য কিন্তু বেশি ‘সংযুক্ত’ মানুষদের জায়গা করে দিতে। অনেকে দক্ষতার চেয়ে কম মানের কাজ নেন, বা শেষমেশ আবার বিদেশে পাড়ি জমান—তাদের শক্তি অপচয় হয়।
প্রতিটি এমন ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়—এটি জাতীয় ক্ষতি।
কেন পাকিস্তানের পক্ষে এটি অসহনীয়
অনেকে বলবেন, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাত সব দেশেই আছে। সত্যি, নিখুঁত সিস্টেম নেই। কিন্তু পাকিস্তানে এ প্রবণতার মাত্রা ও নির্লজ্জতা জাতীয় টিকে থাকার জন্যই হুমকি।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: দেশ তখনই বাড়ে যখন প্রতিভা দক্ষভাবে কাজে লাগে। পাকিস্তান বরং প্রতিভাকে পাশ কাটায়—উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতা রুদ্ধ হয়।
শাসনব্যবস্থা: মধ্যম মানে চলা প্রতিষ্ঠান কখনোই সুশাসন দিতে পারে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও করপোরেটগুলোর ডিজিটাল যুগে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থতা—এটাই প্রমাণ।
তরুণ-অতিরিক্ত জনসংখ্যা: জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশ ৩০ বছরের নিচে—এটি এক জনতাত্ত্বিক ঢেউ। সুযোগ বঞ্চিত হলে হতাশা অস্থিরতায় রূপ নেবে। বেকার ও বিমর্ষ তরুণসমাজসহ একটি দেশ এক টিকটিক বোমা।
মেধার সংস্কৃতির পথে
সমাধান সহজ নয়, তাৎক্ষণিকও নয়। কিন্তু আন্তরিক হলে তা জরুরি ও সম্ভব।
স্বচ্ছ নিয়োগ: প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া নিতে হবে। চাকরির বিজ্ঞাপন, শর্টলিস্টের মানদণ্ড, সাক্ষাৎকারের নম্বর—সবই জনসমক্ষে প্রকাশ হওয়া উচিত।
স্বাধীন তদারকি: নির্বাচন কমিশনের ধাঁচে স্বাধীন সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রক্রিয়া তদারকি করতে হবে।
মেধা-প্রণোদনা: যে প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে মেধাকেন্দ্রিকতা মানে, তাদের রাষ্ট্র ও সিভিল সোসাইটির স্বীকৃতি দিতে হবে। র্যাঙ্কিং, সনদ বা পুরস্কার ইতিবাচক চাপ তৈরি করতে পারে।
ডিজিটাল নিরীক্ষা: প্রযুক্তি সহায়ক হতে পারে। অনলাইন পরীক্ষা, স্বয়ংক্রিয় শর্টলিস্টিং ও ডিজিটাল অডিট ট্রেইল মানবিক কারসাজি কমাবে।
সাংস্কৃতিক রূপান্তর: শেষ পর্যন্ত সমাজ নিজে মেধার মর্যাদা না দিলে কোনো ব্যবস্থা টেকে না। বাবা-মা, শিক্ষক ও নেতাদের শিখতে হবে—ব্যক্তিগত সংযোগ দক্ষতার বিকল্প নয়।
মানবিক মর্যাদার আহ্বান
মেধাকেন্দ্রিকতার দাবিটা আসলে মর্যাদার দাবি। একজন মানুষ বছরের পর বছর শিখে, প্রশিক্ষণ নিয়ে, সাধনা করে—তার প্রাপ্য অন্তত ন্যায্য মূল্যায়নের সুযোগ। সে সুযোগ না দেওয়া মানে কেবল সম্ভাবনা কেড়ে নেওয়া নয়; আত্মমর্যাদাও হরণ করা।
এই সঙ্কটের মানবিক দিকটি খুব কম আলোচিত। অন্যায়ভাবে প্রত্যাখ্যাত পেশাজীবীরা দাগ বয়ে বেড়ান। আত্মবিশ্বাস হারান, নিজের মূল্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কখনো কখনো প্রিয় ক্ষেত্রটাই ছেড়ে দেন। প্রতিটি “অসফল” প্রার্থীর পেছনে থাকে এক পরিবার—যারা আশা, অর্থ ও ত্যাগ বিনিয়োগ করেছে। প্রতিটি মেধাপ্রবাহ-পলায়নের গল্পের পেছনে থাকে নীরব শোক—পাকিস্তান কী হতে পারত।
দ্বিধাবিভক্ত দ্বারপ্রান্তে পাকিস্তান
স্লোগানে দেশ এগোয় না। “তরুণ ক্ষমতায়ন”, “উদ্ভাবন”, “ডিজিটাল পাকিস্তান”—এসব ফাঁপা থেকে যায়, যতক্ষণ না যোগ্যতা-পুরস্কৃত করার সংস্কৃতি তৈরি হয়। মেধাকেন্দ্রিকতা ছাড়া সেরা মস্তিষ্কগুলো অপব্যবহৃতই থাকবে, আর মধ্যমতার চক্র আরও গভীর হবে।
বেদনা এই যে, পাকিস্তানের সমস্যা প্রতিভার ঘাটতি নয়; সমস্যা প্রতিভার সামনে দাঁড় করানো দেয়াল। সেই দেয়াল ভেঙে ফেলতে পারলেই দেশ বিশ্বকে চমকে দিতে পারে।
সময় এসেছে—মেধার প্রতি ঠোঁটসর্বস্ব অঙ্গীকার নয়, বাস্তব চর্চা শুরু করার। স্বজনপ্রীতিতে উপেক্ষিত প্রতিটি পেশাজীবী, ক্যারিয়ারের শুরুতেই নিরুৎসাহিত প্রতিটি তরুণ স্নাতক, “এটা তোমার জন্য নয়” শুনতে হওয়া প্রতিটি নারী—পাকিস্তানের কাছে তাদের দেনা আছে। সেই দেনা শোধ হবে কেবল এমন এক সমাজ গড়ে—যেখানে তুমি কাকে চেনো তার চেয়ে তুমি কী জানো, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তার আগে পর্যন্ত মেধা থাকবে টেবিলের নিচে—আর পাকিস্তান তার মূল্য দিয়ে যাবে।
লেখক: ড.মুরাশ্বের মির, সম্পাদক, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও লেখক