ধনী পরিবারগুলোর মধ্যে এখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এক বিশেষ ধরনের আয়োজন—যেখানে সন্তানদের হঠাৎই জানানো হয়, তাদের নামে অনেক আগেই গড়ে রাখা হয়েছে কোটি কোটি ডলারের ট্রাস্ট। এই অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য একদিকে সম্পদ স্থানান্তরের প্রস্তুতি, অন্যদিকে সন্তানদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা এবং তাদের প্রেরণা অক্ষুণ্ণ রাখা। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এই ধরনের ট্রাস্ট রিভিল বৈঠকের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, যেখানে পরামর্শকরা আগে থেকেই পরিবারকে নিয়ে বৈঠক করে সংবাদটি কীভাবে বলা হবে তার স্ক্রিপ্ট পর্যন্ত তৈরি করে দেন। ম্যাটার ফ্যামিলি অফিসের Luke Jernagan জানান, তিনি এখন বছরে ৩০টিরও বেশি এমন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং প্রায় প্রতিটি রিভিলেই আবেগে ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখা যায়।
বেবি বুমার প্রজন্ম গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শেয়ারবাজারের সাফল্যে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেরুলি অ্যাসোসিয়েটসের হিসাব মতে, ২০৪৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজন্ম ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরিত হবে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পদ, যার বড় অংশই আসবে উচ্চ-নেটওয়ার্থ ব্যক্তিদের কাছ থেকে। কিন্তু এত বিপুল সম্পদ সন্তানের হাতে তুলে দেওয়া এবং তা নিয়ে আলাপ করা বহু ধনী পরিবারের জন্যও সংবেদনশীল ও জটিল ব্যাপার। এই কারণে অতীতে অনেক ক্ষেত্রে ট্রাস্টি বা আইনজীবীর মাধ্যমে তথ্য জানানো হতো কিংবা খামে লিখে রেখে দেওয়া হতো কিভাবে সম্পদ পাওয়া যাবে।

ধনী পরিবারের সন্তানরা বিলাসবহুল স্কুলিং বা বিদেশ ভ্রমণ দেখে পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু ধারণা পেলেও বেশিরভাগ অভিভাবকই প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ জানান না। তারা আশঙ্কা করেন যে সন্তানরা এই সম্পদের কারণে উদ্যম হারাতে পারে। ওয়ারেন বাফেটের বিখ্যাত মন্তব্য এই প্রসঙ্গে বারবার উদ্ধৃত হয়—সন্তানকে এমন পরিমাণ সম্পদ দাও যাতে তারা যা খুশি করতে পারে, কিন্তু এত বেশি নয় যে কিছু না করেও জীবন পার করতে পারে।
এস্টেট লইয়ার, ব্যাংকার এবং ফ্যামিলি অফিস ব্যবস্থাপকরা এখন ধনীর সন্তানদের কাছে সম্পদের বিবরণ জানানোর পাশাপাশি জটিল ট্রাস্ট কাঠামো তৈরি করতে সাহায্য করেন। এসব ট্রাস্টে থাকে শেয়ার, বন্ড, নগদ, পরিবারিক বাড়ি, স্কি লজ, ঐতিহ্যবাহী অলংকার থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও। বাজার বিশ্লেষণ সংস্থা IBISWorld জানায়, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাস্ট থেকে পাওয়া আয় ২৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০০৩ সালের পর সবচেয়ে বড় অঙ্ক।
ক্যালিফোর্নিয়ার হোটেল উদ্যোক্তা সুনীল তোলানি নিজের মালিকানাধীন হোটেল, বসতবাড়ি, স্বর্ণালংকার, ঘড়ি এমনকি স্ত্রীর Hermès ব্যাগ পর্যন্ত বহু-মিলিয়ন ডলারের একটি ট্রাস্টে রেখে দিয়েছেন। তার লক্ষ্য হলো মৃত্যুর পর পরিবারের ভেতরে কোনো বিবাদ সৃষ্টি না হওয়া। তার মতে, ভালোবাসার মানুষদের দেওয়া সবচেয়ে বড় উপহার হলো একটি সুশৃঙ্খল এস্টেট প্ল্যান।
অনেক অভিভাবকই ট্রাস্টের সঙ্গে “লেটার অব উইশেস” যুক্ত করেন, যেখানে তারা লিখে দেন কিভাবে চায় সন্তানরা এই অর্থ ব্যবহার করবে। ব্যাংক অব আমেরিকার Jen Galvagna একটি ৭৫ মিলিয়ন ডলারের ট্রাস্ট পরিচালনা করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল এক সন্তানের ঘোড়দৌড়ের শখ পূরণ করা। ঘোড়া কেনা, তাদের যত্ন, প্রশিক্ষক নিয়োগ, ইনস্যুরেন্স—সবকিছুই এই ট্রাস্টের আওতায় ছিল। অন্য এক পরিবার তাদের সন্তানদের বিশ্বভ্রমণে উৎসাহ দিতে ট্রাস্টে বছরে তিন লাখ ডলার পর্যন্ত ভ্রমণ ব্যয়ের সুবিধা রেখেছে।

ট্রাস্টের মাধ্যমেই সন্তানদের প্রেরণা ধরে রাখতে অনেক পরিবার বিশেষ শর্ত জুড়ে দেয়। কোথাও নির্দিষ্ট GPA অর্জন না করলে টাকা তোলা যায় না, কোথাও বলা থাকে চার বছরের ডিগ্রি সম্পন্ন করলেই নির্দিষ্ট অঙ্ক পাওয়া যাবে। কোনো কোনো ট্রাস্ট আবার চাকরিরত থাকা, মাদকমুক্ত থাকা কিংবা জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছু শর্ত যুক্ত করে। উচ্চ ধনীদের মধ্যে এখন ডাইনাস্টি ট্রাস্ট বিশেষ জনপ্রিয়, যা একাধিক প্রজন্ম ধরে সম্পদ সুরক্ষিত রেখে স্থানান্তর করতে পারে এবং ট্যাক্স কমাতে সাহায্য করে।
এত আয়োজন সত্ত্বেও, অনেক পরিবারই সন্তানদের কাছে সম্পদের তথ্য দিতে ভয় পান। ফিডেলিটির এক জরিপে দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ অভিভাবকই সন্তানদের জানায়নি তারা কী উত্তরাধিকার পাবে; অর্ধেকেরও বেশি নিজেদের নেটওয়ার্থ জানায়নি। কারণ ধনীদের আশঙ্কা—এই খবর সন্তানদের মাঝে দায়িত্বহীনতার প্রবণতা তৈরি করতে পারে।
যতই পরিকল্পনা করা হোক, কখনো কখনো ট্রাস্ট রিভিল অনুষ্ঠানে বিরূপ পরিস্থিতিও তৈরি হয়। গালভাগনা একটি পরিবারে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে রিভিল পরিচালনা করেছিলেন, যেখানে প্রত্যেকে বিশ্বজুড়ে একটি করে বাড়ি পেয়েছে। তবে বাড়িগুলোর মূল্য, অবস্থান, সমুদ্রের দূরত্ব কিংবা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে তুলনা করতে গিয়েই উত্তেজনা তৈরি হয়। তার ভাষায়, সেই রিভিলটি ছিল “খুবই অস্বস্তিকর।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















