মিনিয়াপোলিস সবসময় ঝলমলে। গরমে শহরের অসংখ্য হ্রদের জলে সূর্যের ঝিকিমিকি, আর শীতে বরফ আর তুষারের সাদা আভা—দুই ঋতুতেই এর উজ্জ্বলতা ভিন্ন রূপে ধরা দেয়।
বরফশীতল শীত—আর লম্বা স্বরধ্বনির উচ্চারণ—নিয়ে গল্প প্রচুর হলেও, একে ধীরগতির মহানগর ভেবে ভুল করবেন না। এই মিনেসোটা শহরের রেস্তোরাঁগুলো নিয়মিত জেমস বিয়ার্ড অ্যাওয়ার্ড জিতে, এর সজীব সঙ্গীতজগৎ গড়ে তুলেছে প্রিন্স ও বব ডিলানের মতো কিংবদন্তিকে, আর পুরোটা জুড়েই আমেরিকার আপার মিডওয়েস্টের চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
আমি ছাত্রজীবনে চার বছর মিনিয়াপোলিসে ছিলাম। রয়টার্সের সংবাদদাতা হিসেবে লন্ডন থেকে লাগোস—বিভিন্ন শহরেই থাকি, তবু বছরে অন্তত একবার পরিবার দেখতে এখানে ফিরি।
এ শহরকে স্থানীয়ের মতো উপভোগ করতে আমার সেরা পরামর্শগুলো নিচে দিলাম—
কী করবেন
জলের সান্নিধ্য যেকোনো সফরের প্রধান আকর্ষণ। শহরের নামই এসেছে ডাকোটা ভাষার জল শব্দ “ম্নি” আর গ্রিক “পোলিস” (শহর)—এই দুয়ের সমন্বয়ে। মিসিসিপি নদী শহরটিকে দুই ভাগ করেছে, চারপাশে রয়েছে ২০টিরও বেশি হ্রদ। গ্রীষ্মে কায়াক, পালতোলা নৌকা, ক্যানো বা সাঁতার—যা খুশি করতে পারেন। শীতে আইস স্কেটিং, বরফে মাছ ধরা, কিংবা সাহস থাকলে শূন্য ডিগ্রির নিচের পানিতেও ডুব দিতে পারেন।
আপটাউন এলাকার পাশে থাকা পাঁচটি হ্রদের শৃঙ্খল—চেইন অব লেকস—ঘিরে বার, রেস্তোরাঁ আর কফি শপে ভরপুর। এখানে বৃহত্তম হ্রদ বদে মাকা স্কা-তে ঘণ্টায় ১৫ ডলারে কায়াক ভাড়া নিয়ে হ্রদ থেকে হ্রদে যেতে পারেন; শহরের স্কাইলাইনের দৃশ্যের সঙ্গে উড়ন্ত ঈগল আর লুন পাখির সঙ্গও মিলবে। পানিতে নেমে ঠান্ডা লাগার ভয় থাকলে তীরের পাকা পথ ধরে সাইকেল চালান, স্কেটিং করুন বা হাঁটুন।
ঘাম ঝরিয়ে ফিরে লেক হ্যারিয়েটের ব্রেড অ্যান্ড পিকল থেকে ৮ ডলারের স্থানীয় আইপিএ বিয়ার বা ১৪ ডলারের সিয়ার্ড ওয়ালআই (এলাকার মাছ) স্যান্ডউইচে নিজেকে সতেজ করে নিতে পারেন।
স্থানীয়ের মতো খাওয়া-দাওয়া
ওয়ামনি বাই দ্য সিউক্স শেফ—সেন্ট অ্যান্টনি ফলসের ধারে আলোকময় এক রেস্তোরাঁ—যেখানে সত্যিকারের স্থানীয়ের মতো খেতে পারবেন: আদিবাসী খাবার। ওগলালা লাকোটা সিউক্স শেফ শন শেরম্যানের এই রেস্তোরাঁয় মৌসুমি মেনুতে থাকে কেবল আদিবাসীদের নাগালের খাদ্য—মানে দুধ, গমের ময়দা, চিনি, গরু-শূকর-মুরগি—কিছুই নেই। তাদের মটো: “নৌকায় করে এসেছে—আমরা ব্যবহার করি না।”
এখানে বাইসনের রিবাই, ভেনিসনের ফিলে, বুনো চাল দিয়ে ভরা টমেটো—এমন নানা পদ পাবেন। তবে দামটা সস্তা নয়—দুই জনের সাম্প্রতিক এক মধ্যাহ্নভোজন (ডেজার্টসহ) ট্যাক্স-টিপ মিলিয়ে পড়েছে ১৬৭ ডলার।
শহরের তুলনামূলক সাম্প্রতিক অতীতে ফিরতে চাইলে ডিঙ্কি টাউনের আল’স ক্যাফেতে সকালের নাস্তা খান—১৯৫০-এর দশকের স্মৃতিতে টগবগে। মাত্র ১৪ আসনের কাউন্টারটপ ডাইনার, প্রায় ১০ ফুট (প্রায় ৩ মিটার) ব্যাসের এই ছোট্ট জায়গাটিতে ডিম, হ্যাশ ব্রাউন আর “ওয়ালি ব্লুজ” নামে ব্লুবেরি-আখরোট প্যানকেকের জন্য স্থানীয়রা দশক ধরে লাইনে দাঁড়ায়। বব ডিলান যখন নাম করার আগে আশপাশের কফি শপে গান গাইতেন, তখন যেমন ছিল, আজও তেমনই লাগে জায়গাটা। প্রস্তুত থাকুন—ঠাসাঠাসি বসা, আনলিমিটেড ফিল্টার কফি, আর স্টাফ ও অতিথিদের রসিকতার জন্য। দুই জনের নাস্তা—আরও সাশ্রয়ী—২৭ ডলার।
চলাফেরা
গ্র্যান্ড রাউন্ডস সিনিক বাইওয়ে—শহরকে ঘিরে প্রায় ৫০ মাইল (৮০ কিলোমিটার) দীর্ঘ পার্কওয়ে—ধরে ডাউনটাউন থেকে মিনেহাহা পার্ক ও জলপ্রপাত, সেখান থেকে চেইন অব লেকস পর্যন্ত সাইক্লিং, দৌড় বা হাঁটা—সবই সম্ভব।
কম ক্যালরি পোড়াতে চাইলে লাইট রেল ধরে বিমানবন্দর থেকে ডাউনটাউনে যেতে মাত্র ২ ডলার লাগে; সেখান থেকে এটি কিংবা দ্রুতগতির বাস ধরে শহরতলি—এমনকি বিশাল মল অব আমেরিকা—পর্যন্তও যেতে পারবেন, সামান্য অতিরিক্ত ভাড়ায়।
কেনাকাটা আমার ব্যক্তিগত স্বস্তির উপায় নয়, তবু উল্লেখ না করলে ভুল হবে—মিনেসোটায় পোশাকে বিক্রয়কর নেই। তাই এখানে থাকা অবস্থায় পোশাক কেনা মোটেই খারাপ পরিকল্পনা নয়।
হট টিকিট
মিনিয়াপোলিসে লাইভ সঙ্গীত দেখতেই হবে। কালো মুখাবয়বের জন্য বিখ্যাত ‘ফার্স্ট অ্যাভিনিউ’ শহরের সেরা ভেন্যুগুলোর একটি। আর্ট ডেকো শৈলীর ভবনটি একসময় ছিল গ্রেহাউন্ড বাস ডিপো; ১৯৭০ সালে ব্রিটিশ রক গায়ক জো ককারের পারফরম্যান্স দিয়ে এটি সঙ্গীত ভেন্যু হিসেবে নতুনভাবে চালু হয়।
মিনিয়াপোলিসেই বেড়ে ওঠা প্রিন্স ১৯৮৪ সালের “পার্পল রেইন” চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য এখানেই ধারণ করেছিলেন। ভবনের সাদা তারকা চিহ্নে বহু বিশ্বমানের শিল্পীর নাম জ্বলজ্বল করছে, যারা এখানে মঞ্চ মাতিয়েছেন।
আজও ‘ফার্স্ট অ্যাভিনিউ’-তে শো দেখা যায়; অ্যারেনা অভিজ্ঞতা চাইলে রাস্তা পার হলেই ‘টার্গেট সেন্টার’। আবার আরও স্বস্তিদায়ক কিছু চাইলে গ্রীষ্মজুড়ে শহরের নানা ব্যান্ডশেলে বিনামূল্যের কনসার্ট হয়।
বরফের বিস্ময়
এই উত্তরী অঙ্গরাজ্যে আইস হকি এক প্রতিষ্ঠানের মতো; বাচ্চারা হাঁটতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই স্কেট শিখে। ১৯৮০ সালের অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐ বিখ্যাত “মিরাকল অন আইস” ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্র দলে থাকা ১২ জনই ছিলেন মিনেসোটার, আর তাদের কোচ হার্ব ব্রুকসও এখানকারই—যিনি দলকে জয় পাইয়ে দেন।
এনএইচএলের ‘মিনেসোটা ওয়াইল্ড’ খেলেন পাশের ‘টুইন সিটি’ সেন্ট পলে; তবে আপনি মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গোল্ডেন গফারস’-কে ৩এম অ্যারেনা অ্যাট মারিউচ্চি বা রিডার অ্যারেনায় দেখতে পারেন। শহর জুড়ে আরও আছে অসংখ্য হাই স্কুল, ইয়ুথ বা পিক-আপ গেম।
স্থানীয় কথাবার্তা
এখানে এসে স্থানীয়ের মতো কথা বলবেন নাকি? আয়তাকার পাত্রে বানানো গরম আর মজাদার পদকে বলা হয় “হট ডিশ”—ক্যাসেরোল নয়। বাচ্চারা খেলে “ডাক, ডাক গ্রে ডাক”—“ডাক, ডাক, গুস” নয়। হকি খেলা হয় বরফের ওপর, মাঠে নয়। বিরক্তি প্রকাশ করতে বলেন “উফ দা!”, উত্তেজনায় “ইউ বেচা!”, আর মিষ্টি কোনো কিছু দেখলে বলেন “ওহ ফর কিউট।”
সবচেয়ে বড় ভুল ধারণা
শুধু গ্রীষ্মেই নাকি আসা যায়—এ ধারণা ভুল। তাপমাত্রা নামলেই শহরটা নতুন প্রাণ পায়। জমে যাওয়া পুকুরগুলো পরিণত হয় আইস-স্কেটিংয়ের স্বর্গে; লেক হ্যারিয়েটে ঠান্ডা জলে ডুব দেওয়ার জায়গাটির মজার নাম “ম্যাজিক হোল”; প্রাইস ব্রুইং-এর মতো জায়গাগুলোর খোলা-আকাশের সাউনা আপনাকে শীতার্ত না করেই দৃশ্যসৌন্দর্য উপভোগ করতে সাহায্য করবে।
বরফের ওপর ফুটো করে মাছ ধরার জন্য গরম রাখা ছোট্ট ঘর—‘আইস-ফিশিং শ্যান্টি’—ভাড়াও নিতে পারেন। অথবা শহরটিকে চিনতে পারেন ‘স্কাইওয়ে সিস্টেম’ ধরে—ডাউনটাউনের বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ভবনকে সংযোগকারী দ্বিতীয় তলায় নির্মিত পথঘাট, যা আপনাকে কামড়ানো ঠান্ডা হাওয়া আর তুষার থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যায়।
সিটি মেমো: তথ্যপত্র
আইসক্রিমের এক স্কুপের দাম: লাউরি হিলের সেবাস্টিয়ান জোজ-এ সিঙ্গেল স্কুপ ৪.২৫ ডলার—স্থানীয় মালিকানার এই দোকানটির তিনটি শাখা আছে; ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তারা নিজস্ব স্বাদের আইসক্রিম বানাচ্ছে।
কী কিনবেন: চতুর্থ অ্যাভিনিউ ও ফ্র্যাঙ্কলিনের মোড়ে ‘ইলেকট্রিক ফিটাস’-এ ঢুঁ মেরে একটা ভিনাইল রেকর্ড নিয়ে নিন। দোকানে আছেন সঙ্গীতপাগল কর্মীরা—আপনার পছন্দের অ্যালবাম খুঁজে দেবেন। ভাগ্য ভালো হলে বিনামূল্যের ইন-স্টোর পারফরম্যান্স বা লিসনিং সেশনও দেখতে পারেন। ভিনাইল ৫ ডলার থেকেই মিললেও সংগ্রহযোগ্য কপির দাম শত ডলারে ওঠে—যেমন জন কোলট্রেনের ১৯৬৪ সালের “ক্রেসেন্ট” অ্যালবামের এক প্রোমো কপি বিক্রি হচ্ছে ৩৯৯.৯৯ ডলারে।
সূর্যাস্ত দেখার সেরা জায়গা: মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ওয়াশিংটন অ্যাভিনিউ ব্রিজের পূর্ব তীর থেকে ডাউনটাউন স্কাইলাইন পেরিয়ে সূর্যাস্ত দেখা যায়। আরও উজানে স্টোন আর্চ ব্রিজ—একদা রেলপুল—প্রথম ডেটে আসা মানুষ, কুকুর হাঁটানো বা দৌড়তে বেরোনো স্থানীয়দের ভিড়ে থাকে সরগরম।
সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়: মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়, টুইন সিটিজ—আমার আলমা ম্যাটার—যেখানে ছাত্রসংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ‘হানিক্রিস্প’ আপেল থেকে শুরু করে রিট্র্যাক্টেবল সিটবেল্ট—বিভিন্ন আবিষ্কারের কৃতিত্ব পায়।
সবচেয়ে বড় নিয়োগদাতা: কারগিল, টার্গেট কর্পোরেশন, ইউনাইটেডহেলথ, জেনারেল মিলস—এগুলোসহ বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানির প্রধান কার্যালয় বৃহত্তর মিনিয়াপোলিসে।